ব্ল্যাক ফ্রাইডে
এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে ব্ল্যাক ফ্রাইডের বিষয়টা অনেকেই জানে। আমি ভালো করে জানতে পারি আমেরিকায় যাওয়ার পর। ইউএসএতে যাওয়ার পর থেকেই সবাই বলত বড় ধরণের কোন কেনাকাটা থাকলে তা যেন ব্ল্যাক ফ্রাইডে (Black Friday) এর সময় কিনি। বিশেষ করে ল্যাপটপ, টিভি এই ধরণের বড় জিনিসের উপর খুব ভালো সেল থাকে। এটা নাকি ইউএস এর সব চাইতে বড় সেল।
প্রতি বছর নভেম্বরের ৪র্থ বৃহস্পতিবারে ব্ল্যাক ফ্রাইডে উদযাপন করা হয়। ১৯৫২ সাল থেকে থ্যাঙ্কসগিভিং(Thanksgiving) এর পরের দিন এই দিনটি পালন করা হয়ে আসছে। এই ব্ল্যাক ফ্রাইডে (Black Friday) থেকে ক্রিসমাসের কেনাকাটা শুরু হয়। প্রচুর কেনাকাটা হয়ে থাকে। তাই ঐ সময় খুব ভিড় হয়।
আমাদের যদিও তেমন কোন কেনাকাটা ছিলনা তবুও ব্যাপারটা কি তা দেখার একটু আগ্রহ ছিল। তাছাড়া এই এক বছরে যতটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায় তার পুরোটুকুই আমি নিতে চাই। এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাই না।
২০০৯ এর ব্ল্যাক ফ্রাইডে ছিল ২৭ শে নভেম্বর। আমাদের কোরবানির ঈদ। ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে ওদের বন্ধ থাকে। আমরাও সৌভাগ্যবশত ঈদের বন্ধ পেয়ে গেলাম। ভার্জিনিয়া স্টেটে গরু জবাইয়ের অনুমতি নেই। ভার্জিনিয়ায় বাঙ্গালীরা কোরবানিতে বাঙ্গালী বা পাকিস্তানী দোকানে টাকা দিয়ে দেয়। ঐ দোকান থেকে নির্দিষ্ট গরু জবাইয়ের ফার্মে গিয়ে গরু জবাই করে। এভাবেই ভার্জিনিয়ার মুসলিমরা কোরবানি দিয়ে থাকেন। কোরবানীর গোশত পেতে পেতে সন্ধ্যা বা পরদিন হয়ে যায়। একেক প্রদেশে (State) একেক নিয়ম। আটলান্টায় নিজেরা ফার্মে গিয়ে গরু জবাই করে কোরবানি দেয়। তাই তাদের গোশত সন্ধ্যার মধ্যে পেয়ে যায়। আবার ফ্লোরিডায় বাংলাদেশের মত মাঠে কোরবানি করা হয় এবং মাঠেই ঈদের নামাজ আদায় করা হয়।
ব্ল্যাক ফ্রাইডের (Black Friday) দৃশ্য দেখার জন্য আমরা ওয়ালমার্ট (Walmart) কে নির্ধারণ করলাম। ওয়ালমার্ট (Walmart) এ যেতে আমার বাসা থেকে ১৫-২০ মিনিট লাগে। তখন বেশ শীত পড়া শুরু হয়ে গেছে। সবার কাছ থেকে শুনেছি রাত ১২ টায় গিয়ে লাইন ধরতে হবে। আমরা একটু রিস্ক নিয়েই রাত ৪ টার দিকে রওয়ানা দিলাম। পৌঁছালাম প্রায় ৪:২০ এর দিকে। অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। বিশাল পার্কিং লটে কোন পার্কিং পাওয়া যাচ্ছিল না। তার উপর মানুষের লাইন ওয়ালমার্টের বিশাল এলাকা শেষ করে ঘুরে ২য় লাইনে শেষ হয়েছে। আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম।
ভীষণ শীত, হাঁড় কাঁপানো শীতে কেউবা পুরো পরিবার নিয়ে, কেউ বাচ্চা নিয়ে লাইনে দাঁড়ানো। মানুষের যে বিশাল লাইন তা অবাক করার মত। কিন্তু খুব সুশৃংখল অবস্থা বিরাজমান। কারণ ২০০৮ এ নাকি ওয়ালমার্টে (Walmart) মানুষ ঢুকতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিতে ২ জন মারা গিয়েছে। তাই এবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব জোরদার করা হয়েছে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে (Black Friday) এর এমন মানুষের চাপ আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা করুন দশা জানান দিচ্ছে। আমার শুধু বারবার মনে হচ্ছিল আমাদের দেশে কখনো কখনো যাকাতের কাপড়ের জন্য এই রকম ভিড় হয়। তাও সব বছর নয়। আর এখানে প্রতি ব্ল্যাক ফ্রাইডে (Black Friday) এর এমন চিত্র স্বাভাবিক। আমরাও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
সকাল ৬ টায় দোকান খুলেছে। সাড়ে ৬ টায় মাইকে ঘোষণা করা হলো ল্যাপটপের টোকেন শেষ। যারা ল্যাপটপ নিতে এসেছে তারা যেন ফেরত যায়। কেউই ফেরত যায় না, কেউতো আর শুধুমাত্র ল্যাপটপের জন্য আসেনি!। আমরা প্রায় ঘণ্টা খানেক লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ভিতরে ঢুকতে পেরেছি। শীতে আমাদের অবস্থা যুবুথুবু, তবুও অভিজ্ঞতাটা অর্জন না করে যেতে চাইলাম না। যারা কেনাকাটা করতে এসেছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ হলো স্প্যানিশ, আফ্রিকান-আমেরিকান। বাঙ্গালী যাদের সাথে পরিচয় হয়েছিল এবং অনেক বছর ধরে আমেরিকায় আছেন তারা সবাই বলল, শুধু একবারই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য গিয়েছে।
আমরা ভিতরে ঢুকতে ঢুকতেই দেখি মোটামুটি যেসব জিনিস সেল দিয়েছে তার সবকিছুই প্রায় শেষ। টিভি, ল্যাপটপতো শেষই এমনকি শীতের কাপড়ও প্রায় শেষ। কারণ যে কাপড় ৭০-৮০% সেল দিচ্ছে সকাল ১১ টার পর তা আবার রেগুলার দামে চলে আসবে। তাই সবাই হুড়মুড় করে যে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে নিচ্ছে। আমরাও আমাদের কেনাকাটা সাড়ে ৭ টার মধ্যে শেষ করে ফেলেছি। আমার স্বামী শপিং কার্টটা একপাশে রেখে কোকাকোলা আনতে গিয়েছে , এসে দেখে আমাদের কার্ট নেই। কী আর করা, খালি হাতেতো আর ফিরে যাওয়া যায় না। তাই আবার প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া জিনিস থেকে যা কিছু পেলাম তা নিয়ে চলে আসলাম। খুব ভালো অন্যরকম এবং বিরল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো জীবনে।
সকালে বাসায় এসে বাচ্চাদেরকে ঘুম থেকে উঠালাম। এরপর আমার স্বামী আর ছেলে গেল ঈদের নামাজে। কোরবানির জন্য দেশেই টাকা পাঠালাম তাই এখানে তেমন কোন ঝামেলা হলো না। সন্ধ্যায় বাচ্চাদেরকে নিয়ে পেন্টাগন রো আউটডোর আইস স্ক্যাটিং (Pentagon Row Outdoor Ice skating) এ গেলাম। খোলা জায়গায় আইস স্ক্যাটিং (Ice skating) করার জন্য কৃত্রিমভাবে আইস ফিল্ড তৈরি করা হয়েছে। প্রচন্ড শীত, ভারী ভারী কাপড়ে শীত মানছিল না। বাচ্চারা খুব মজা পাচ্ছিল, ওরা বারবার পড়ে যাচ্ছে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে, আবার আইস স্ক্যাটিং (Ice Skating) করছে। ওদের আনন্দের কাছে আমাদের শীত যেন কিছুই না।
শীতের দেশ তাই শীতকে কতটা ভালোভাবে উপভোগ করা যায় সেটাই যেন এই দেশের মানুষের লক্ষ্য। শীতের দেশে শীত-বরফ এগুলো আপন করে নিয়ে চলতে পারাটাই কৃতিত্ব। শীত উপেক্ষা করে ব্ল্যাক ফ্রাইডের কেনাকাটা করাটাই শীতকে জয় করার বড় উদাহরণ। আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে দারুণ এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো।