মা দিবস এ সকল মাকে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। প্রতিটি সন্তানের কাছে তার মা’ই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মা। পবিত্র কোরআনে এবং হাদীসে মাকে অনেক সম্মান দেওয়া হয়েছে। মাকে নিয়ে রয়েছে অনেক কবিতা। তার মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি কবিতা এবং সাথে আমার একটা কবিতা শেয়ার করছি। যাদের মা বেঁচে আছে তাদেরকে বলবো মা চলে গেলে বুঝবেন জীবনে কী সম্পদই না হারালেন। তাই বেঁচে থাকতেই তাঁর গুরত্ব কমতে দিবেন না।
মা
কাজী কাদির নেওয়াজ
মা কথাটি ছোট্ট অতি,
কিন্তু জেনো ভাই,
ইহার চেয়ে নামটি মধুর
তিন ভূবনে নাই।
সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক
মাথার’ পরে আজি
অন্তরে মা থাকুক মম
ঝরুক স্নেহরাজি।
রোগ-বিছানায় শুয়ে শুয়ে
যন্ত্রণাতে মরি
সান্তনা পাই মায়ের মধু
নামটি হৃদে স্মরি।
বিদেশ গেলে ঐ মধু নাম
জপ করি অন্তরে,
মন যে কেমন করে আমার
প্রাণ যে কেমন করে।
মা যে আমায় ঘুম পাড়াত
দোলনা ঠেলে ঠেলে,
শীতল হতো প্রাণটা মায়ের
হাতটা বুকে পেলে।
মাগো, আমি বিদেশ থেকে
দিচ্ছি তোমায় চিঠি,
কেমন আছ জানতে চাহি,
দেখতে চাহি দিঠি।
তোমায় স্মরি চোখ ফেটে মোর
অশ্রু যে আজ ঝরে,
প্রাণ যে কেমন করে আমার
মন যে কেমন করে।
অন্য মা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার মা না হয়ে তুমি
আর কারো মা হলে
ভাবছ তোমায় চিনতেম না,
যেতেম না ঐ কোলে?
মজা আরো হত ভারি,
দুই জায়গায় থাকত বাড়ি,
আমি থাকতেম এই গাঁয়েতে,
তুমি পারের গাঁয়ে।
এইখানেতে দিনের বেলা
যা-কিছু সব হত খেলা
দিন ফুরোলেই তোমার কাছে
পেরিয়ে যেতেম নায়ে।
হঠাৎ এসে পিছন দিকে
আমি বলতেম, “বল্ দেখি কে?”
তুমি ভাবতে, চেনার মতো
চিনি নে তো তবু।
তখন কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে
আমি বলতেম গলা ধরে–
“আমায় তোমার চিনতে হবেই,
আমি তোমার অবু!”
ঐ পারেতে যখন তুমি
আনতে যেতে জল,–
এই পারেতে তখন ঘাটে
বল্ দেখি কে বল্?
কাগজ-গড়া নৌকোটিকে
ভাসিয়ে দিতেম তোমার দিকে,
যদি গিয়ে পৌঁছত সে
বুঝতে কি, সে কার?
সাঁতার আমি শিখিনি যে
নইলে আমি যেতেম নিজে,
আমার পারের থেকে আমি
যেতেম তোমার পার।
মায়ের পারে অবুর পারে
থাকত তফাত, কেউ তো কারে
ধরতে গিয়ে পেত নাকো,
রইত না একসাথে।
দিনের বেলায় ঘুরে ঘুরে
দেখা-দেখি দূরে দূরে,–
সন্ধ্যেবেলায় মিলে যেত
অবুতে আর মা-তে।
কিন্তু হঠাৎ কোনোদিনে
যদি বিপিন মাঝি
পার করতে তোমার পারে
নাই হত মা রাজি।
ঘরে তোমার প্রদীপ জ্বেলে
ছাতের ‘পরে মাদুর মেলে
বসতে তুমি, পায়ের কাছে
বসত ক্ষান্ত বুড়ী,
উঠত তারা সাত ভায়েতে,
ডাকত শেয়াল ধানের খেতে,
উড়ো ছায়ার মতো বাদুড়
কোথায় যেত উড়ি।
তখন কি মা, দেরি দেখে
ভয় হত না থেকে থেকে,
পার হয়ে, মা, আসতে হতই
অবু যেথায় আছে।
তখন কি আর ছাড়া পেতে?
দিতেম কি আর ফিরে যেতে?
ধরা পড়ত মায়ের ওপার
অবুর পায়ের কাছে।
মা
কাজী নজরুল ইসলাম
যেখানেতে দেখি যাহা
মা-এর মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!
হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
মায়ের শীতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
কত করি উৎপাত
আবদার দিন রাত,
সব স’ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!
আমাদের মুখ চেয়ে
নিজে র’ন নাহি খেয়ে,
শত দোষে দোষী তবু মা তো ত্যাজে না।
ছিনু খোকা এতটুকু,
একটুতে ছোট বুক
যখন ভাঙিয়া যেতো, মা-ই সে তখন
বুকে করে নিশিদিন
আরাম-বিরাম-হীন
দোলা দেয় শুধাতেন, ‘কি হোলো খোকন?’
আহা সে কতই রাতি
শিয়রে জ্বালায়ে বাতি
একটু আসুখ হলে জাগেন মাতা,
সব-কিছু ভুলে গিয়ে
কেবল আমারে নিয়ে
কত আকুলতা যেন জগন্মাতা।
যখন জনম নিনু
কত আসহায় ছিনু,
কাঁদা ছাড়া নাহি জানিতাম কোন কিছু,
ওঠা বসা দূরে থাক-
মুখে নাহি ছিল বাক,
চাহনি ফিরিত শুধু মার পিছু পিছু।
তখন সে মা আমার
চুমু খেয়ে বারবার
চাপিতেন বুকে, শুধু একটি চাওয়ায়
বুঝিয়া নিতেন যত
আমার কি ব্যথা হোতো,
বল কে ওমন স্নেহে বুকটি ছাওয়ায়।
তারপর কত দুখে
আমারে ধরিয়া বুকে
করিয়া তুলেছে মাতা দেখো কত বড়,
কত না সে সুন্দর
এ দেহ এ অন্তর
সব মোর ভাই বোন হেথা যত পড়।
পাঠশালা হ’তে যবে
ঘরে ফিরি যাব সবে,
কত না আদরে কোলে তুলি’ নেবে মাতা,
খাবার ধরিয়া মুখে
শুধাবেন কত সুখে
কত আজ লেখা হোলো, পড়া কত পাতা?’
পড়া লেখা ভাল হ’লে
দেখেছ সে কত ছলে
ঘরে ঘরে মা আমার কত নাম করে।
বলে, ‘মোর খোকামনি!
হীরা-মানিকের খনি,
এমনটি নাই কারো!’ শুনে বুক ভরে।
গা’টি গরম হলে
মা সে চোখের জলে
ভেসে বলে, ‘ওরে যাদু কি হয়েছে বল’।
কত দেবতার ‘থানে’
পীরে মা মানত মানে-
মাতা ছাড়া নাই কারো চোখে এত জল।
যখন ঘুমায়ে থাকি
জাগে রে কাহার আঁখি
আমার শিয়রে, আহা কিসে হবে ঘুম।
তাই কত ছড়া গানে
ঘুম-পাড়ানীরে আনে,
বলে, ‘ঘুম! দিয়ে যা রে খুকু-চোখে চুম’।
দিবানিশি ভাবনা
কিসে ক্লেশ পাব না,
কিসে সে মানুষ হব, বড় হব কিসে;
বুক ভ’রে ওঠে মা’র
ছেলেরি গরবে তাঁর,
সব দুখ সুখ হয় মায়ের আশিসে।
আয় তবে ভাই বোন,
আয় সবে আয় শোন
গাই গান, পদধূলি শিরে লয়ে মা’র;
মা’র বড় কেহ নাই-
কেউ নাই কেউ নাই!
নত করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!
আমার মা
সুলতানা পারভিন
মা আমার ছিল প্রতিভাময়ী
ছিলেন এক অসাধারণ নারী
শতকের মাঝে যায় কী পাওয়া
এমন মা একজনা?
ছিলেন তিনি লাস্যময়ী
সদালপী এক হাস্যময়ী
যায় না ভোলা তাঁর ব্যবহার
এমনি এক মহান নারী।।
অপূর্ব তাঁর লিখনীর হাত
সূচীকর্মে সমদক্ষতা তাঁর,
ধর্মেও নয় কম তিনি
কী করে তাঁকে ভুলি আমি!