আমার দৃষ্টিতে স্বপ্নের দেশ-৭ । আমেরিকার স্কুলিং পদ্ধতি

আমেরিকার স্কুলিং পদ্ধতি

ছেলের স্কুলের কার্যক্রম শেষ করে গেলাম ‘গানস্টোন মিডেল স্কুল’ (মাধ্যমিক) এ। আমার মেয়ের স্কুল। পাশাপাশি স্কুল। হেঁটে এক স্কুল থকে আরেক স্কুলে যাওয়া যায়।

ইলিমেন্টারী স্কুলে একজন শিক্ষক সব বিষয়ের ক্লাস নিয়ে থাকেন। আর মিডেল স্কুলে প্রত্যেক বিষয়ের জন্য একজন করে শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট কোন ক্লাস নেই। ছাত্র-ছাত্রীরা সময় অনুযায়ী বিষয় ভিত্তিক শিক্ষকের রুমে গিয়ে ক্লাস করে আসে।

ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আছে নির্দিষ্ট লকার। তাদেরকে ভারী ভারী ব্যাগ বয়ে বেড়াতে হয় না। সব বই স্কুলেই থাকে। যখন কোন প্রয়োজন হয় তখন বই বাসায় নিয়ে আসত।

এই এক বছরে “স্বপ্নের দেশের” পড়ালেখার পদ্ধতিটা খুব ভালো লেগেছে। এক বছরে ওদের কখন পরীক্ষা হতো টের পেতাম না। শুধু “ESOL-English” (প্রবাসীদের জন্য) এর সময় খুব বেশি করে জানিয়ে দিত পরীক্ষার কথা। ৩ মাস পর পর রেজাল্ট কার্ড নিয়ে এলে বুঝতাম ওদের টার্ম এক্সাম হয়েছে। 

ওদের তেমন একটা বাড়ির কাজ ছিল না। যেসব পড়া দেওয়া হতো তা শেষ করতে বড়জোর এক/দেড় ঘণ্টা লাগত। আর উইকেন্ডে তো কোন পড়াই থাকত না। বরং উইকেন্ডে আনন্দ করার জন্য বলা হতো। সপ্তাহের শুরুতে জিজ্ঞেস করত উইকেন্ডে তারা কে কি করেছে।

অথচ দেশে আমার দুই বাচ্চাকে সন্ধ্যায় পড়াতে বসলে রাত ১১ টার আগে কখনো পড়ার টেবিল থেকে উঠতে পারিনি। নার্সারি থেকেই আমাদের বাচ্চাদের পড়ার চাপ শুরু হয়ে যায়। এত বেশী পড়ার চাপ, বইয়ের চাপ সবকিছুই অতিরিক্ত। আমাদের দেশের স্কুলে উইকেন্ড মানে অতিরিক্ত পড়া।

ইউএসএ  তে বাচ্চারা ধীরে ধীরে বড় ক্লাসে উঠে তখন ওদের পড়ার চাপও একটু একটু করে বাড়ে। হাইস্কুল থেকে ওদের পড়ার চাপ বাড়ে। যখন বাচ্চারা সত্যি চাপ নেওয়ার মত শক্তি অর্জন করে। 

ওদের পড়ার চাপ বেশী না থাকলেও ওরা অনেক কিছু শেখে। তাদের সাধারণ জ্ঞান অনেক বেশি। ওদের ছাত্র-ছাত্রীদের ‘Extra Curriculum activities’ এর মাধ্যমে প্রত্যেককে এমনভাবে তৈরি করে নেয় যেন এই বিশেষ যোগ্যতাকে জীবনের বিশেষ প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারে। ,

আমার ছেলে মেয়ে অনেক কিছু শেখার সুযোগ পেয়েছে। আবার অনেক কিছু শিখতে পারেনি ধারাবাহিকতার জন্য। যেমন সাঁতার শিখাতো গ্রেড ফোর (Class-IV) থেকে, গীটার শিখাতো গ্রেড সিক্স (Class-VI) থেকে। তাই তারা ওগুলো ধরতে পারেনি। তবুও তারা অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে। 

আমার ছেলে তাঁর জীবনে প্রথম বাড়ির বাহিরে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। স্কুল থেকে আউটডোর ল্যাবে নিয়ে গিয়েছিল।ওখানে জঙ্গলে রাত কাটিয়েছে, সাপ ধরেছে, অনেক কিছু করেছে। ভায়োলিন, বাঁশি বাজানো, কারাতে শিখেছে স্কুল থেকে। 

ওদের স্কুলে অনেক প্রোগ্রাম হতো। গ্রেড ফাইভে গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে ওদের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। একদম ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের মত হয়। স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশনের ডেট প্রথমেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সময় জানার পর দেখা গেল আমাদের কোর্স শেষ হবার পর আরো কিছু দিন থাকতে হবে। আমাদের ইন্সটিটিউশন থেকে কোর্স শেষে ১০ দিন ছুটি দেওয়া হয়। যাতে করে বাচ্চাদের স্কুলের সব কার্যক্রম শেষ করে যেতে পারি।

আমার মেয়েও স্কুল থেকে বই বানানোসহ অনেক কিছু শিখেছে। সে শারীরিকভাবে অতো শক্ত সামর্থ্য নয়। কিন্তু তার স্কুলে অনেক শারিরীক কার্যক্রম হতো যা তার জন্য খুবই কাজে লেগেছে।

হাইস্কুল পর্যন্ত আমেরিকার পড়ালেখা অবৈতনিক। কিন্তু এরপর উচ্চতর ডিগ্রী নিতে গেলে অনেক খরচ। তাই আমেরিকায় এক জরিপে দেখা গেছে তাদের যুব সমাজের ৭৫ ভাগ আর্মিতে ঢুকার জন্য অনুপযুক্ত। কারণ মিডেল স্কুল থেকেই ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এর উপর আছে ড্রাগ আসক্তি যা আমেরিকার এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। 

হাইস্কুল পাশ করেই কোনরকম একটা চাকুরি জুটাতে পারলেই হলো। এতে করে তার থাকা, খাওয়া, লোন নিয়ে গাড়ি করার একটা বন্দোবস্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই কষ্ট করে আবার উচ্চতর ডিগ্রীর দরকার কি? এজন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঋণ নিতে হয়, যা তাকে চাকুরী পাওয়ার পর অনেক বছর যাবত টানতে হয়। 

আমেরিকানরা জীবনকে খুব ভালোভাবে উপভোগ করে। তারা সপ্তাহে ৫ দিন কাজ করবে আর ২ দিন খুব ফুর্তি করবে। ভবিষ্যতের জন্য ওদের তেমন কোন চিন্তা থাকে না। নিজেকে নিয়ে ভালো থাকলেই হলো। তাদেরতো আর আমাদের মত পারিবারিক দায়বদ্ধতাটা নাই। হয়ত জীবন ব্যবস্থা এমন বলেই আমাদের দেশের মত মানুষকে এই দেশ এত টানে। আমাদের কাছে কারো একটা গাড়ি, একটা বাড়ি থাকা বিশাল ব্যাপার, হোক না সেটা ঋণ করে, তাতে কি। 

ওদের হাইস্কুল পর্যন্ত ফ্রি হলেও বিভিন্নভাবে অনেক বিল আসত যা হিসেব করলেও কম নয়। সর্বোপরি আমেরিকার স্কুলিং পদ্ধতিটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। আমি যত বাঙ্গালীকে জিজ্ঞেস করেছি আমেরিকার থাকার প্রধান কারণ কি? সবার একটাই উওর ছিল-“ছেলে মেয়েদের ভালো পড়া লেখার পরিবেশ হল আমেরিকার থাকার মূল কারণ”। আসলেই তাই। এই বিষয়ে আমার কোন দ্বিমত নাই।

Leave a Comment