ডিজনি ওয়ার্ল্ড
আমেরিকায় বেড়ানো জায়গাগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে ডিজনি ওয়ার্ল্ড। বাচ্চাদের আমেরিকাতে যে কয়েকটি জায়গা দেখার শখ ছিল তার মধ্যে প্রথম চাওয়া ছিল ডিজনি ওয়ার্ল্ড (Disney World)। ডিজনি ওয়ার্ল্ড বেড়ানোর জন্য কমপক্ষে ৩-৪ দিন সময় দেওয়া প্রয়োজন এবং একটু ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকের ইচ্ছে থাকলেও সাধ ও সাধ্যের সম্বন্বয় ঘটাতে পারেনা।
ডিসেম্বরে সবার ছুটির সময়ে ডিজনি ওয়ার্ল্ড এর টিকেট কাটা হলো। সে অনুযায়ী অনলাইনে গাড়ি ভাড়া করা হলো। নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ ১৮ তারিখে আমরা ৮ টার ভিতর গাড়ি নিয়ে রওয়ানা দেওয়ার কথা। আমার স্বামী রেন্ট এ কার থেকে গাড়ি আনার জন্য গেল। কিন্তু তাঁর আর দেখা নাই। একটু পর সে ফোন করে জানাল রেন্ট সার্ভিস থেকে ঝামেলা করছে। তারা ডেভিড কার্ড গ্রহণ করে না। ক্রেডিট কার্ড ছাড়া তারা পেমেন্ট নেবে না। আমেরিকার কিছু কিছু অদ্ভুত নিয়মের এটা একটা। এক বছরের অধিবাসীদের তারা ক্রেডিট কার্ড দেয় না অথচ ওদের অনেক কিছুতেই ক্রেডিট কার্ড চায় এবং ক্রেডিট হিস্ট্রি না থাকলে অনেক দোকানের কার্ডও পাওয়া যায় না।
ব্যাপারটা একটু গোলমেলে হয়ে গেল। আমরা যখন ২ মাস আগে বুকিং দিয়েছিলাম তখন ওরা ডেভিড কার্ডই গ্রহণ করেছিল অথচ এখন বলছে হবে না। দুমাস আগে যিনি বুকিং নিয়েছিলেন তিনি এখন ডিউটিতে থাকলে কোন সমস্যা হতো না। ওদের যখন ডেস্কে যে থাকে তখন তার নিয়মই নিয়ম। তার মর্জির উপর সব কিছু নির্ভর করে। কোনমতেই আমার স্বামী ডেস্কের লোকটাকে বোঝাতে পারলো না। অবশেষে আমাদের সেই পরপোকারী ভাইয়ের দ্বারস্থ হতে হলো। উনি এসে উনার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে অতিরিক্ত কিছু চার্জ লাগিয়ে সকাল ১০টায় গাড়ি নিয়ে দিল।
এদিকে আবহাওয়া চ্যানেল জানাল আজ থেকে তুষারপাত শুরু হবে এবং এবার সেটা বিশাল আকারের হবে। আমরা রওয়ানা দিলাম। আমাদের পিছন পিছন তুষারপাতও দৌঁড়াল। আমার এবং আমার বাচ্চাদের জন্য এটাই প্রথম তুষারপাত (Snowfall)দেখা। ডিজনি দেখতে যাচ্ছে সেই আনন্দের সাথে বাচ্চাদের মন খারাপ যোগ হলো তুষারপাত (Snowfall)টা দেখতে পারছে না বলে।
৪ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমরা নর্থ ক্যারোলিনায় পৌঁছালাম। সেখানে পূর্ব পরিচিত এক বাঙ্গালী ভাইয়ের বাসায় গেলাম। মফস্বল এলাকা। দারুণ সুন্দর একটা বাড়ি। বিশাল এলাকা, বাড়ির পিছনের দিকে ঘন জঙ্গল। জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝে হরিণ উনাদের বাড়ির পিছনের দিকে আসে।
এখানেও তুষারপাত শুরু হয়েছে এবং ছাদে হালকা বরফ জমা শুরু করেছে। হালকা বৃষ্টিও হচ্ছিল। দুপুরে ভাইয়ের বাসায় খেয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম সাউথ ক্যারোলিনার দিকে। ভাই এবং তার পরিবারের আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ হয়ে ফিরলাম।
ভীষণ বৃষ্টি সঙ্গে ঝড় শুরু হয়ে গেল। রাত ৮ টার দিকে পৌঁছালাম সাউথ ক্যারোলিনায়। রাতটা কাটিয়ে আবার ভোরে রওয়ানা দিব। আমাদের মোটেল আগেই বুকিং দেওয়া ছিলো। ভোররাত ৫টায় রওয়ানা দিলাম ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে।
রাস্তা ফাঁকা এবং অন্ধকার। আমার স্বামী হঠাৎ হঠাৎ করে গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে দেয়। এখানে একটু পর পর গতিসীমা উল্লেখ করা আছে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৭০ মাইল/ঘণ্টা। কিন্তু উনি মাঝে মাঝে এই সীমা অতিক্রম করে ৮০/৯০ তে চালাচ্ছিল। ভেবেছেন অন্ধকার রাত, খালি রাস্তা, গতিবেগ বাড়ালে কী আর হবে?
আটলান্টা পার হয়ে ফ্লোরিডায় যেতে হয়। সকাল ৮ টার দিকে ফ্লোরিডায় প্রবেশ করেছি। আমরা ধারণা করেছিলাম এভাবে চললে ১২ টার মধ্যে আমরা ডিজনিতে পৌঁছে যাব। ভোররাতের চিত্র আর এখনকার চিত্র পুরো ভিন্ন। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। আমার স্বামী সবসময় বলত আমেরিকাকে অচল করতে হলে ওদের গ্যাস সিস্টেমটা অচল করে দিলেই হবে। আসলে তাই সব গাড়ি বন্ধ মানে আমেরিকা অচল। ভাবতেই ভয় লাগে।
হঠাৎ আমরা খেয়াল করলাম আমাদেরকে সবাই বামদিকের লেইনটা ছেড়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একজনকে বামদিকের লেইনে দেখা যায়। সকাল ৮:৩০ টার দিকে দেখি একটা পুলিশ গাড়ি আমাদেরকে সিগন্যাল দিচ্ছে। আমাদের বুঝতে একটু সময় লাগছিল যে ইউএসএতে পুলিশের গাড়ির সিগন্যাল দেখলে বামদিকের লেইন ছেড়ে দিতে হয়।
যখন বুঝতে পারলাম আমাদেরকে বামদিকের লেইন ছেড়ে দেওয়ার কারণ তখন আমরা বামপাশেই পার্ক করলাম। পুলিশ অফিসার এলো এবং বলল আমরা ওভার স্পীড করেছি। ওদের স্কাই মনিটরে দেখা যাচ্ছে আমরা ৮৯ মাইল/ঘণ্টাতে গাড়ি চালিয়েছিলাম। অতএব আমাদেরকে $২৮৭ এর টিকেট দিল (ওরা জরিমানাকে টিকেট বলে)। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জরিমানা জমা দিয়ে দিতে হবে।
একটু মন খারাপ হলেও শিক্ষনীয় ঘটনাটা মেনে নিলাম। আমেরিকায় গাড়ি চালানোর সময় ওভার স্পীড করলে যে ধরা তা মনের ভিতর গেঁথে রাখলাম। অবশেষে ৪টা প্রদেশ পার হয়ে ৫ম প্রদেশ ফ্লোরিডার ডিজনি ওয়ার্ল্ড এ দুপুর ১ টার দিকে পৌঁছালাম।