আমেরিকায় দ্বিতীয় বাঙ্গালী পরিবারের সাথে পরিচয়
আমাদের পৌঁছার কয়েক দিনের মধ্যেই সবার আইডি কার্ড হয়ে গেছে। আমার স্বামী ইউএসএ মিলিটারি কার্ড পেয়ে গেছেন। সাথে আমাদেরকেও মিলিটারি ফ্যামিলি কার্ড দিয়ে দিয়েছে। তার মানে আমরা এখন থেকে মিলিটারী সদস্যদের সব সুবিধা পেতে পারি।
মিলিটারি সদস্যদের জন্য ‘কমিসারী’, মানে ডিসকাউন্টেড শপ রয়েছে। যেখানে বিশেষ ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। আমাদের বাসার কাছাকাছি কমিসারিটা ‘ফোর্ট মায়ার’ নামক একটা নেভী বেস এর মধ্যে। বাসা থেকে খুব বেশী দূরে নয়। আমরা স্বপরিবারে একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিয়েই বাজার করার জন্য ফোর্ট মায়ারের কমিসারীতে চলে গেলাম। সেখানে বেসের ভিতর ট্যাক্সি থাকা নিষেধ। তাই আমাদেরকে নামিয়ে দিয়েই ট্যাক্সি ফেরত চলে আসতে হবে। ফেরার পথে ট্যাক্সি পাওয়া যাবেনা জেনে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে অনুরোধ করলাম যেন আমরা ফোন করলে আবার ভিতরে চলে আসেন। ট্যাক্সি ড্রাইভার কল করলে চলে আসবে বলে ফেরত চলে গেল।
কেনাকাটা শেষ করে যখন চেক আউট কাউন্টারে এলাম। দেখলাম বাঙ্গালী চেহারার একজন কাউন্টারম্যান। জানতে চাইলাম উনি বাঙ্গালী কিনা? বললেন হ্যাঁ বাঙ্গালী। এরপর ওনাকে অনুরোধ করে উনার থেকে ফোন থেকে ট্যাক্সি ক্যাবের ড্রাইভারকে কল করলাম। তখনও আমরা ফোন নিতে পারিনি। ড্রাইভার জানালো তার ১০ মিনিট সময় লাগবে ভিতরে আসতে।
আমরা বাজার নিয়ে কমিসারীর লবিতে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এমন সময় এলো ঝুম বৃষ্টি, সে কি বৃষ্টি! আমরাতো জিনিসপত্রসহ কার্ট নিয়ে অনেক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। সেখান থেকে বেসের গেইট অনেক দূরে। তাই হেঁটেও গেটের কাছে যেতে পারছিনা। আবার বৃষ্টির কারণে যারা নিজ গাড়ী নিয়ে যাচ্ছে তাদের কাউকে অনুরোধও করতে পারছি না।
পরে জানতে পারলাম এই বেসে ঢোকার জন্য ঐ ড্রাইভারের কার্ড ছিল না বলে সে ঢুকতে পারছিল না। বাসায় ফেরত যাবার কোন উপায় না দেখে নিজেদেরকে খুব অসহায় মনে হতে লাগল। আমাদের অবস্থা দেখে কাউন্টারের সেই বাঙ্গালী ভাই এসে বললেন, “আপনারা কোন চিন্তা করবেন না। আমার একটু পরেই ডিউটি শেষ হয়ে যাবে, আমি আপনাদেরকে বাসায় পৌঁছে দিব।” আমাদের মনে হলো ফেরেস্তা নেমে এসেছে আমাদের জন্য। উনার ডিউটি শেষ হওয়া পর্যন্ত আমরা আরো কিছু সময় অপেক্ষা করলাম।
উনি আমাদের নিয়ে চললেন আমাদের বাসার উদ্দেশ্যে। আমাদের বাসার ঠিকানা দিলাম, যা তিনি জিপিএসে সেট করলেন। আমাদের বাসায় পৌঁছতে বড় জোর ১০ মিনিট সময় লাগার কথা। কিন্ত বাসার পাশ দিয়ে সঠিক মোড়ে না ঘুরার কারণে অন্য রাস্তায় চলে গেলেন। আর সেখান থেকে কোন ইউ টার্ণ করতে না পারার কারণে সোজা চলে গেলেন ওয়াশিংটন ডিসিতে। ইউ এসএ তে সঠিক সময়ে সঠিক ইউটার্ণ না নিতে পারলে ভিন্ন দিকে চলে যাবেন।
মজার ব্যাপার হলো ভুল করে হলেও সেদিনই আমরা প্রথম ওয়াশিংটন ডিসিতে ডুকলাম। আমদের বাসা আর্লিংটনে হলে তা ছিলো ওয়াশিংটন ডিসির পাশে। একটা রাস্তা পার হলেই ওয়াশিংটন ডিসি।সেখান থেকে ফেরার রাস্তা পেতে অনেক ঘোরাঘুরির পর প্রায় ঘন্টাখানেক পর বাসায় পৌঁছালাম। আমরাতো খুবই অনুতপ্তবোধ করতে লাগলাম, কারণ আমাদের কারণে বেচারা ভাইয়ের এই অতিরিক্ত ড্রাইভিংটা করতে হল। অথচ তিনিই উল্টো আমাদেরকে ঠিকমত বাসায় নিয়ে না আসতে পারার কারণে লজ্জিত হলেন।
পরদিন ভাই আবার বাসায় এসে আমাদের খবর নিলেন। তখন থেকেই তিনি আমাদের প্রায় সব প্রয়োজনে – মোবাইল নেওয়া, দূরে শপিং মলে নিয়ে যাওয়া, গাড়ি কেনা ইত্যাদি সব কাজেই সহায়তাদানকারী ভাই। তিনি এবং তার পরিবারের সাথে আমাদের খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল। আমরা প্রায়ই তাদের বাসায় যেতাম এবং তারাও আমাদের বাসায় আসতেন।
আমাদের গাড়ী কেনার আগে পর্যন্ত তিনিই আমাদেরকে প্রায়শ দূরের বিভিন্ন শপিং মলে নিয়ে যেতেন। যাওয়া আসার সময় মাঝে মাঝে আমার স্বামীকে তাঁর গাড়ী চালাতে দিয়ে আমেরিকার রাস্তায় গাড়ি চালানোয় সাহসী করে তুললেন। ওখানকার গাড়ি চালানো আমাদের দেশের চেয়ে ভিন্ন। আমরা রাস্তার বাম দিকে চলি, ওরা ডান দিক দিয়ে চলে। আমাদের ড্রাইভিং সিট থাকে গাড়ির ডান দিকে আর ওদের বাম দিকে। ওখানকার বেশিরভাগ রাস্তাই একমুখী চলাচল আর রাস্তায় অনেকগুলো লেন থাকে। সেজন্য গাড়িগুলো খুব হাইস্পীডে চলে। একটু অসাবধান বা লেনচ্যূত হলে মারাত্বক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে।
আমাদের সাথে পরিচিত হওয়া দ্বিতীয় বাঙ্গালী ভাইটি ডিভি পেয়ে ৬ বছর হলো আমেরিকায় এসেছেন। দেশে রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। দেশে এলে উনার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। তাই ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিলো না। কিন্ত ভাই দেশকে খুব মিস করতেন। ভাই বেশ পরপোকারী এবং সাদা মনের মানুষ ছিলেন।