২০২৩ এর আগস্টের ২৯ তারিখ ছিলো পূর্ণিমার রাত। আমরা ৩০ তারিখ রাতে পুর্ণিমার ২য় রাত নিকলী হাওরে কাটাবো বলে ঠিক করি। শুনেছি হাওরের পূর্ণিমার রাতের সৌন্দর্য নাকি বর্ণনাতীত। আর সেই পুর্ণিমা যদি হয় বিশেষ পূর্ণিমা তাহলেতো ষোলকলায় পূর্ণ। কেন বিশেষ পূর্ণিমা? কারণ জ্যোতিষ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন ২০২৩ এর আগস্টের এই পূর্ণিমার চাঁদের মত এত বড় চাঁদ আবার ৩৭ বছর পর দেখা যাবে। তাই এই বিশেষ পূর্ণিমা বিশেষ স্থান থেকে অবলোকন করে রাতটা স্মরণীয় করে রাখতে চাইলাম। মূলত আমাদের এক স্থানীয় বন্ধু ডাক্তার দম্পতির আমন্ত্রণে আমাদের নিকলী হাওর ও পূর্ণিমা রাত উদযাপন সফর।
আমরা একটা মাইক্রো নিয়ে দুপুর ১২টায় ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের দিকে রওয়ানা দিলাম। পথে ভৈরবে্র একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেলাম। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ার চরে পৌঁছালাম বিকেল ৩ টায়। এরপর গাড়ি দিয়ে আর যাওয়া যাবে না। কুলিয়ার চর বাজারের ঘাট থেকে স্পীড বোটে করে অষ্টগ্রাম যাব। স্পীড বোটে অষ্টগ্রাম পৌঁছাতে লেগেছে ৪৫ মিনিট। হাওরের মাঝ দিয়ে যেতে বিশাল হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে একটা দ্বীপের মত জায়গা দেখা যায় তাতে কিছু জনবসতি। কী সংগ্রামী জীবন এই হাওর বাসীর।
অষ্টগ্রামে নেমে অটো নিলাম। অটো ছুটে চলল ইটনা-অষ্টগ্রাম-মিঠামইন রাস্তা দিয়ে। রাস্তাটি প্রায় ৩০ কিলোমিটার লম্বা। পথে যেতে যেতে নেমে কিছু খাওয়া দাওয়া ও ছবি তোলা চলল। পানির মাঝ দিয়ে এই রাস্তা বানানোটা কতটা চ্যালেঞ্জ ছিলো তা না দেখলে উপলদ্ধি করা কঠিন। চারপাশের অবস্থা দেখে বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছিল এই রাস্তা তৈরি করাটাই ছিলো একটা দুঃসাধ্য সাধন। এই রাস্তা এই এলাকার মানুষের জন্য একটা আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। অন্যরকম একটা সৌন্দর্য, নির্মল পরিবেশ।
আমাদের বন্ধু জানালো এই বছর পানি কম উঠেছে। অন্য বছর এই সময়ে পানি রাস্তা ছুঁই ছুঁই অবস্থায় থাকে। আমরা যখন গেলাম তখন পানি রাস্তা থেকে অনেকটাই নীচে ছিলো। তার মতে এবার পানি কম হওয়ায় রাস্তার প্রকৃত সৌন্দর্য নাকি দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার মাঝখানে তিন দিকে ৩ টা রাস্তা চলে গিয়েছে। একটা অষ্টগ্রাম, একটা ইটনা, একটা মিঠামইনের দিকে। আমাদের সময় স্বল্পতার জন্য আমরা ইটনার দিকে যাই নি। সোজা চলে গেলাম মিঠামইন।
সেখান থেকে একটা ইঞ্জিন চালিত বড় নৌকা ভাড়া করে আমরা আমাদের রিসোর্ট “প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট” এর দিকে রওয়ানা দিলাম। ২০ মিনিট লাগলো পৌঁছাতে। এরই মধ্যে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। প্রেসিডেন্ট রিসোর্টে ঘাট থেকে উপরে উঠলে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের গলফ কার্ট দিয়ে ভিলায় নামিয়ে দিয়ে আসে। ভিলা থেকে ঘাট ১০ মিনিট হাঁটা দুরত্ব। বিশাল হাওরের মাঝ খানে ঘেরাও দিয়ে এই রিসোর্টটি করা হয়েছে। মাঝখানে বিশাল পুকুর আর চারপাশে রিসোর্টের বিভিন্ন স্থাপনা। একদিকে থাকার জায়গা আর দিকে খাবারের রেস্টুরেন্ট। ৩০ একর জায়গা জুড়ে রিসোর্টটি করা হয়েছে। মাত্র একবছর হলো এই রিসোর্টের বয়স। এখনও অনেক কাজ বাকী আছে।
পূর্ণিমা উদযাপন করব বলেই আমরা একরাত রিসোর্টে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম। রাত আটটার মধ্যে খাবার অর্ডার করতে হয় এবং ১০টার মধ্যে ডিনার শেষ করতে হয়। আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে গেলাম। বিশাল পুকুরের একপাশে রিসোর্টের রুম অন্যপাশে রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য বোট, গলফ কার্ট রয়েছে। আমরা বোটে করে ৫/৬ মিনিটের মধ্যে রেস্টুরেন্টের ঘাটে পৌঁছালাম।
ডিনার শেষ করে সুন্দর, নির্মল বাতাস ও জ্যোসনার আলোতে হাঁটতে হাঁটতে রুমে এলাম। এই রিসোর্টের ভিলাগুলো পানির উপর। বারান্দায় বসে আপনি হাওরের রূপ উপভোগ করতে পারবেন। ভিলাগুলো্র মাঝে আরেকটা শান বাঁধানো ঘাট আছে। সেখানেও বসার সুব্যবস্থা আছে। আমরা সবাই মিলে সেখানে চলে গেলাম। আহ কী অপরূপ দৃশ্য। মনে হলো হাওর ট্যুর আর বিশেষ পূর্ণিমা এখানে না এলে অনেক কিছু অপূর্ণ রয়ে যেত।
পূর্ণিমার আলো আর ভরা জোয়ার একই সময়ে। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে সেই শান বাঁধানো ঘাটে। ঢেউ এর শব্দ এত সুমধুর লাগছে সাথে হালকা মিষ্টি বাতাস! আমরা কেউ পা ডুবিয়ে বসে আছি, কেউ গলা ছেড়ে গান ধরেছে, কেউ কেউ উদাসী হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে এই রাত যদি শেষ না হতো! কিন্তু এই মুগ্ধতা সারাদিনের ক্লান্ত শরীর বেশীক্ষণ ঘুমকে আটকে রাখতে পারেনি। ঘুমের কাছে হার মেনে রাত একটা পর্যন্ত সবাই মিলে এক অনাবিল, সুখময় একটা পূর্ণিমা উপভোগ করলাম। যা হাওরে না গেলে সত্যি মিস করতাম।
পরের দিন ভোরে রিসোর্টের নির্জন পরিবেশ আর হাওরের স্নিগ্ধ বাতাসে মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল। হাঁটতে হাঁটতে রেস্টুরেন্টে গিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। সকালের রেস্টুরেন্ট থেকে হাওরর অন্যরকম সৌন্দর্য দেখতে পেলাম।
রিসোর্টের পরিবেশ ভালো তবে অনেক অব্যবস্থাপনা রয়েছে। ওদের সেবার মান আরো উন্নত করতে হবে। ভাড়ার তুলনায় সেবা অনেক নিম্নমানের।
রিসোর্ট থেকে বের হতে হতে ১১টা বেজে গেল। নৌকা আগেই ভাড়া করা ছিলো। নৌকা করে আমরা মিঠামইন গেলাম। সেখান থেকে অটো নিয়ে গেলাম মিঠামইন রাস্তার শেষ মাথায়। ওখান থেকে দাঁড়িয়ে ওপাড়ে ক্যান্টনমেন্ট হচ্ছে সেটা দেখা যায়। সেখান থেকে গেলাম প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের বাড়ি দেখতে। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে গেলাম অষ্টগ্রামে ৪০০ বছরের পুরানো মসজিদ কুতুব শাহী মসজিদ দেখার জন্য। কুতুব শাহী মসজিদ দেখে আমাদের বন্ধু ডাক্তার দম্পতির বাড়িতে দুপুরে ভুড়ি ভোজ করে বিকেল ৪টার দিকে স্পীড বোটে করে কুলিয়ার চরে পৌঁছালাম। তারপর সেখান থেকে আমাদের মাইক্রো করে ঢাকায় ফেরা। ফেরার পথে বারবার মনে হচ্ছিল হাওরবাসীর সংগ্রামী জীবনের কথা। কত কষ্ট আর প্রতিকুলতার মধ্য থেকে এখান থেকে কত সফল মানুষ হয়েছেন। তাদের জন্য শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল।
আমাদের এই ছোট্র নিকলী হাওর ট্যুর আমাদের ব্যস্ত জীবনে কাজের গতিকে অনেক বেগবান করেছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট্র ভ্রমণগুলো আমাদের জীবনে টনিক হিসেবে কাজ করে। হতাশা দূর করে, জীবনকে গতিময় করে। সবার উচিত একটুখানি সময় বের করে ছোট ছোট ট্যুর করা। আমরা যারা ডিপ্রেশনে ভুগছি তারা কাজের মাঝে একদিনের জন্য হলেও কোথাও থেকে ঘুরে আসুন দেখবেন মনে অন্যরকম একটা অনুভূতি পাবেন। আস্তে আস্তে ডিপ্রেশন কেটে যাবে। ভালো থাকুন নিজের জন্য। নিজের জন্য বাঁচতে শিখুন। নিজে ভালো করে বাঁচতে পারলে অন্যকে বাঁচাতে পারবেন, অন্যকে ভালো রাখতে পারবেন।