আমার দৃষ্টিতে স্বপ্নের দেশ ২৮ । ব্যাগেজ বিড়ম্বনা

ব্যাগেজ বিড়ম্বনা

আমাদের সাড়ে এগারো মাসের সফর প্রায় শেষ হয়ে এলো। দেশে ফেরার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। জাতিগতভাবে আমাদের আবেগ একটু বেশি। কোথাও বেড়াতে গেলে বিশেষ করে বিদেশে গেলে আত্নীয় স্বজনের জন্য সামান্য কিছু হলেও উপহার সামগ্রী আনার চেষ্টা করি। আমেরিকার লাগেজ নিয়ম অনুযায়ী আমরা সাধারণভাবে ৫০ পাউন্ড করে ৪ জন মোট ৮ টা ব্যাগ পাবো। কিন্তু মিলিটারীদের জন্য প্রতি ব্যাগের ওজন ৭০ পাউন্ড করে এবং জনপ্রতি ১ টা করে অতিরিক্ত ব্যাগ বরাদ্ধ অর্থাৎ আমাদের ৪ জনের ১২টা ব্যাগ যার প্রতিটির ওজন ৭০ পাউন্ড করে পাওয়ার কথা। আমরা সেই সুবিধা পাবো কিনা তা জানার জন্য আমাদের লিজিং কোম্পানী ওদের হেড অফিসের সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত করল যে আমাদের জন্য মিলিটারীদের জন্য যে ব্যাগেজ নিয়ম তা প্রযোজ্য হবে। আমরা মহা ফূর্তিতে কেনাকাটা করে ৫০ পাউন্ডের ব্যাগকে ৭০ পাউন্ড করা শুরু করলাম।

লিজিং কোম্পানীর মালিক শেরণ। তার সাথে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। শেরণকে কয়েকবার নিমন্ত্রণ করেছিলাম সাথে তার মা ও বোনকেও বাসায় দাওয়াত করে খাইয়েছিলাম। শেরণের ভাষ্য অনুযায়ী এই প্রথম সে তার ক্লায়েন্টের বাসায় দাওয়াত খেয়েছে। আমাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী তখন তাদেরকে দেশকে থেকে আনা কিছু উপহার দিয়েছিলাম। যা পেয়ে উনারা খুব অবাক হয়েছিলেন।

আমাদের চলে যাওয়ার সময় হয়েছে জেনে শেরণের মা গিফট নিয়ে আমাদেরকে বিদায় জানাতে এসেছেন। উনার গিফট পাওয়ার পর আমি এবারও তাকে আরেকটা গিফট করি। যেটা পেয়ে উনি আবেগে আপ্লুত  হয়ে কেঁদে দিলেন আর আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন আমি উনার পালিত কন্যা। গিফট পেয়ে এমন আপ্লুত ও ভালোবাসা আমাকেও আবেগতাড়িত করেছে। উনাকে দেওয়া গিফটগুলো মূল্যের হিসেবে খুব দামী কিছু ছিলো না কিন্তু তার মূল্যায়ন ছিলো অমূল্য!

শ্যারণ আমার কর্তাকে জানাল আমাদের এক বিদেশী বন্ধুকে এয়ারপোর্টে তুলে দিতে গিয়ে দেখেছে তাকে মিলিটারী স্কেলে ব্যাগেজ নিতে দিচ্ছে না। শ্যারণ ফ্রন্ট ডেস্কারকে বলল, আমি তোমাদের হেড অফিসে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি এরা মিলিটারী স্কেলে ব্যাগেজ পাবে। ফ্রন্ট ডেস্কার কোনমতেই তা মানবে না। তার কথা হচ্ছে যখন যে ডেস্কে থাকবে তার কথাই শেষ কথা। শ্যারণ নিজেও খুব আহত হলো তার দেশের এই অদ্ভুত নিয়মের জন্য।

আমাদের মাথায় বাজ পড়ল। কারণ ইতিমিধ্যে আমরা অনেক কেনাকাটা করে ফেলেছি! কিছু এমন জিনিস কিনলাম যা ফেলে দেওয়া বা ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না। এখনতো শিপম্যান্ট করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। সময়ও খুব কম। তারা অবাক হয়ে জানতে চাইল এত কী কিনেছি? আমার যে লম্বা আত্নীয়ের লিস্ট তাদের সবার জন্য একটু একটু করে কিছু নিলেও অনেক জিনিস হয়ে যায়। তাছাড়া আমরা একবছর ছিলাম নিজেদেরও কিছু জিনিস হয়ে গেছে যা ফেলে আসতে ইচ্ছে করছে না। হাতে সময় খুবই কম, মাত্র ১০ দিন বাকি। ব্যাগ ৩টা করে নিতে পারব তবে ওজন ৫০ পাউন্ড। এর মধ্যে সব লাগেজগুলো খুলে আবার ৫০ পাউন্ড করতে হবে! তার উপর আমার কর্তা কোমরে ব্যাথা পেয়ে ১ সপ্তাহ বেড রেস্টে থাকতে হয়েছে।

খোঁজ করতে থাকলাম কোথায় কম খরচে শিপম্যান্ট করা যায়। এক্সট্রা ব্যাগেজ আর ওজন পাবো বলেই কয়েকটা জিনিস বাড়তি কিনেছিলাম। ৭০ পাউন্ডের লাগেজগুলোকে খুলে আবার ৫০ পাউন্ড করলাম। আমাদের বদলীর চাকুরী। ১৬ বছরের সংসার জীবনে ১২ বার বাসা পাল্টানোর অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু তখন না থাকে ওজনের হিসাব, না থাকে লাগেজের হিসাব। তখন এসব কাজে সাহায্যকারী পাওয়া যায়। আমাদের যে এইরকম সাহায্যকারী, ড্রাইভার, মালি, কাজের লোক থাকে তারা এই ব্যাপারটাকে অনেক বড় করে দেখে। বলে তোমরাতো অনেক ধনী। আমি বলতাম হ্যাঁ এই হিসেবে আমরা ধনী তা বলতেই পারো। যাহোক এবার ৩ বার লাগেজ গোছাতে আর ওজন করতে করতে  হাঁপিয়ে উঠলাম। ওজন কমাতে গিয়ে আমার ছেলে মেয়ের অনেক পছন্দের জিনিস ফেলে দিতে হলো। শুরু হলো ব্যাগেজ বিড়ম্বনা।

আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে জানলাম নিউইয়র্কে এক বাঙ্গালী ভাই আছেন যিনি কমখরচে শিপম্যান্ট করেন। কিন্তু জিনিস ওখানে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। একটা গাড়ি ভাড়া করে এবং লিজিং কোম্পানীর একজন লোককে নিয়ে জিনিসগুলো ওখানে দিয়ে আসে। লিজিং কোম্পানীর লোকটাকে তার ওয়ার্কিং সময়ের এর বাহিরে যে সময় ছিল তার জন্য তার আলাদা রেটে পেমেন্ট করতে হয়েছে। আমরা যেমন কারো সাথে একটু ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলে তার জন্য অতিরিক্ত অনেক সার্ভিস দিয়ে থাকি, বিদেশে সেটা দেখতে পাইনি।  ফ্রন্ট ডেস্কের নিয়মের জন্য  আমাদের কিছু ক্ষতিপূরণ দিতে হলো।

অবশেষে আমাদের দেশে ফেরার দিন এলো। লিজিং কোম্পানীর মালিকসহ এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। ওখানকার ফ্রন্ট ডেস্কার আমার কর্তার মিলিটারী আইডি কার্ড দেখে জানালো আমরা মিলিটারী স্কেলে লাগেজ নিতে পারব। তখন আমাদের যে কি অবস্থা তা আর বলে বোঝাতে পারব না। এদিকে আমাদেরকে ৪ জনের ৪ টা অতিরিক্ত লাগেজ নেওয়ার জন্য ইউনিভার্সিটির থেকে একটা কুপন দিয়েছিল। এয়ারপোর্টে আসার পর আবিষ্কার হলো এই কুপনটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। যেহেতু ব্যাগের ওজন ৭০ পাউন্ড করে তাতে কুপন হারালেও ব্যাগের জিনিস এদিক ওদিক করে সামাল দেওয়া গেলো। আমাদের সাথে আর্মির যে ভাই ছিলেন উনার একটা কুপন আমাদেরকে দিয়ে সব কোনরকমে সব ম্যানেজ হলো।

যাহোক আল্লাহ তায়লা আমাদেরকে সাহায্যকারী হিসাবে এই ফ্রন্ট ডেস্কারকে পাঠিয়েছেন। তা না হলে আমাদের অতিরিক্ত ৪ টা লাগেজ পেমেন্ট করে আনতে হতো যা হতো আমাদের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতন।

Leave a Comment