ভুতুর জনপ্রিয়তা ছিল প্রচুর। আমার বন্ধুর পাঁচটা বিড়াল আছে। সে আমার বাসায় এলেই আগে ভুতুকে কোলে নিবে। সবসময়ই তার খোঁজখবর রাখবে।
আমার বাসায় একজন সাহায্যকারী ছিলো একসপ্তাহের জন্য। সে মাঝে মাঝে ফোন করে আমার ছেলে মেয়ের খবরের সাথে ভুতুর খবর জিজ্ঞেস করবে।
আমার বাসায় যেই আসে সে যাওয়ার পর থেকেই ভুতুর খবর নেয়। তেমনি কয়েকজন হলো আমার বোনের মেয়ে, ননদের মেয়ে, আমার দেবর, শাশুড়ি। তাদেরকে নিয়মিত ভুতুর ছবি পাঠাতে হয়।
২০২২ এর ফেব্রুয়ারির কথা। আমি বাড়িতে গিয়েছি ১৬ তারিখে। দুদিন পর বাসার বাকিরা যাবে। ভুতুকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু আমি ছাড়া ৫-৬ ঘন্টার রাস্তায় তাকে কেউ সামলাতে পারে না। তাই সিদ্ধান্ত হলো তাকে তার মায়ের চুরিবাড়িতে বেড়াতে পাঠানো হবে। অর্থাৎ আমার মেয়ের বন্ধুর বাসায়।
যথারীতি তাকে নিয়ে আমার ছেলে মেয়ে বাসা থেকে কোলে নিয়ে বের হলো। লিফট থেকে তার মিউ মিউ শুরু হয়ে গেল। আধা ঘন্টার রাস্তায় সে সারাক্ষণ মিউ মিউ করে বিরক্ত করে গেছে। এরপর তার মায়ের বাসায় নেওয়ার পর আরেক কান্ড। কারোর সাথে মিশেই নি উলটা ঐ বাসার দুটো বিড়ালকে খামচি দিয়েছে। ওই দুটো বিড়াল একটা তার মা আরেকটা তার ভাগ্নে!। ভুতু খাটের নিচে লুকিয়ে থাকে, আবার একটু পরে খাটের উপর চুপটি করে বসে থাকে।
আর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মা আর ভাগ্নে তাকে দূর থেকে দেখে। প্রথম দিন ভুতু হাঙ্গার স্ট্রাইক করে কিছুই খায়নি। পরের দিন ঐ বাসার বাবুটা তাকে হাতে করে ধরে একটু খাইয়েছে।
আমরা পরেরদিন তাকে নিয়ে এসেছি। আমি গাড়িতে ছিলাম, আমার ছেলে মেয়েরা তাকে এনে আমার কোলে দিলো। কী আর বলবো! ভুতু আমার কোলে উঠে বুকে মাথাটা যে লুকালো আর কোন শব্দ করলো না। ওই ভাবে বুকের সাথে লেগে ছিলো। বাসায় আসতে প্রায় ৩০-৪০ মিনিট লেগেছিলো একটা শব্দ ও না, একটুও নড়াচড়া করলো না সারাপথ। যেই না আমরা বাসার সামনে আসলাম সঙ্গে সঙ্গে লিফটে ঢুকে গন্ধ শুঁকে চিনে নিলো এটা তার বাসার লিফট। লিফটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন দরজা খুলবে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে আমাদের বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খোলার অপেক্ষা করতে লাগলো। দরজার খুলতে দেরী ভুতুর ঢুকতে দেরী নাই।
যে ভুতু তার পরিবারকে এতো ভালো বাসে তাকে কী ভালো না বেসে পারা যায়!!
চিরবিদায় ভুতু
আমরা আমাদের নিজের ফ্ল্যাটে উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সেজন্য কয়েকদিন আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম। ভুতু বেসিনের উপর গিয়ে বসে থাকে। ভাবলাম তার মনে হয় গোসল করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মার্চের ৩ তারিখ ২০২২, সকালে ভুতুকে আমি আর আমার হাসবেন্ড দুজনে মিলে গোসল করিয়ে দিলাম। ওকে একা কখনো গোসল করানো যায় না। খুব বিরক্ত করে। তাকে গোসল করানোর সময় একজন সহযোগী লাগে। আজ গোসল করানোর সময় ভুতু খুব শান্ত ছিলো।
গোসল করানোর পর তাকে আমি মুছে দিলেও সে নিজে নিজে গা চেটে আরও শুকিয়ে নেয়। আজ তাকে রোদে রেখে আসার পরও সে গা চাটছিলো না।
এদিকে আমাকে বাসার কাজে বের হতে হবে। বেলা তখন এগারোটা। আমি আমার ছেলেকে বলে গেলাম ভুতুর দিকে খেয়াল রাখতে। আমি বাইরে থেকে দুবার ফোন করে খবর নিলাম। ছেলে জানালো ভুতু চুপচাপ শুয়ে আছে।
বাসায় ফিরলাম ৩টার দিকে। ঘরে ঢুকে ভুতু বলে ডাকলাম, ম্যাও করে কাছে আসল। খাবার দিলাম খেলো না, খুব অস্হিরতা শুরু করল। গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ আর বমির মতো শব্দ করতে লাগলো। আর এপাশ ওপাশ করতে লাগলো। তার অস্হিরতা দেখে আমি অস্হির হয়ে আমার জানা সকল ভেটকে ফোন দিতে থাকলাম। কয়েকজনকে ফোন দেওয়ার পর একজনকে পেলাম।
তার পরামর্শ মতো ভুতুকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভুতু একবার বাথরুমের ভিতরে গড়িয়ে পড়ে আরেকবার ঘরে, কী যে এক কষ্টকর দৃশ্য তা বলে বোঝানো যাবে না। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে আমার কোলে এসে মুখ দিয়ে ফেনা বের করে সে চলে গেল আমাদের ছেড়ে। তখন বিকেল ৩ঃ২৫ মিনিট।
আমার মনে হচ্ছিল সে আমার আসার অপেক্ষায় ছিল। তার চলে যাওয়াটা আমাদের পরিবারের সকল সদস্য সবাই খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। প্রায়ই তার স্মৃতি আমাদের নাড়া দিয়ে যায়। বিড়াল ভালবাসা আদায় করে নিতে পারে। আমি এতো বিড়াল প্রেমী ছিলাম না, ভুতুই আমাকে বিড়ালদের প্রতি ভালোবাসা জন্মিয়েছে। বিড়াল যে বিষন্নতা কাটাতে সাহায্য করে এই কথাটা ভুতু না থাকলে আমি বুঝতে পারতাম না। বিড়াল নিয়ে অনেক অনেক কথা শুনতাম তা বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে ভুতুকে পেয়ে। ভুতু মারা যাওয়ার পর ওয়াদা করেছিলাম আর বিড়াল পুষব না। কারণ বিড়াল মারা গেলে যে কষ্ট তা বারবার পেতে চাই না। জানি না ক’দিন তা ধরে রাখতে পারব!