লাইভ মিউজিয়াম ও থীম পার্ক
বিদেশের মাটিতে এই প্রথম রোজা উদযাপন করলাম। দেখতে দেখতে রোজা শেষ হয়ে গেল। রোজার ঈদ এলো। আত্নীয় স্বজন ছাড়া এই প্রথম ঈদ (২০ সেপ্টম্বর’২০০৯)। তবুও স্বামী, বাচ্চারা আছে এটাই সান্ত্বনা। ঈদ ভালোই কাটল। আমরা একা ভেবে আমাদের কিছু পরিচিত বন্ধু-বান্ধব এলো আমাদের সঙ্গ দিতে। আবার এক বাঙ্গালী ভাইও নিমন্ত্রণ করলেন উনার বাসায়। প্রবাসে অন্যরকম ঈদ উদযাপন করলাম। সেদিন রবিবার হওয়াতে বন্ধ পেয়েছিলাম। দেশে ঈদের দিন চারপাশে একটা ঈদ ঈদ ভাব থাকে, সেই ভাবটা খুব মিস করলাম।
২৫শে সেপ্টেম্বর থেকে ৪ দিনের একটা ফ্যামিলি অফিসিয়াল ট্যুরে নিয়ে গেল। প্রথমদিন একটা মিউজিয়ামে গেলাম। বিশাল এলাকা। রেড ইন্ডিয়ানদের জীবন যাপন কেমন ছিলো সেটা্র উপর নির্ভর করে এই মিউজিয়াম। ওদের বাসস্থান, জীবিকা নির্বাহ পদ্ধতি সব তুলে ধরা হয়েছে। বাসস্থানের জন্য চটের তৈরি ডিম্বাকৃতি ঘর আর শিকার ছিলো তাদের একমাত্র পেশা। সেগুলো ভালো ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
২৬শে সেপ্টেম্বর আমাদেরকে ভার্জিনিয়ার (Virginia) বুশ গার্ডেন (Busch Garden) এ নিয়ে যাওয়া হলো। এটা একটা থীম পার্ক। ৩৮৩ একর এলাকা জুড়ে এই পার্ক। বিভিন্ন ধরণের রাইড আছে যার মধ্যে রোলার কোস্টারের রাইডগুলো ছিল ভয়ানক এবং মজার। অনেক উচুঁ থেকে যখন হাই স্পীডে নীচের দিকে নামে তখন মনে হয় জীবনটা শেষ। প্রতি মুহুর্তে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা। আমার মত দূর্বল চিত্তের মানুষদের এই ধরণের রাইড ত্যাগ করা উচিত। একটায় উঠে আর সাহস হয়নি দ্বিতীয়টায় উঠার। তবে আমার চাইতেও দূর্বল চিত্তের আধিকারীদের দেখেছি , এই সকল রাইডের ধারের কাছেও ঘেষেনি।
প্রচুর এডভ্যাঞ্চার টাইপের রাইড রয়েছে। আমার বাচ্চারা এই ধরণের রাইড খুব পছন্দ করে। ওরা খুব সাহসী, মায়ের মতো দূর্বল চিত্তের নয়। তাই তারা একটা রাইডও বাদ দেয়নি। সারাদিন সবাই খুব মজা করল। ঐদিন আমার মেয়ের জন্মদিন ছিল। আমার মেয়ে মনে করে এইটাই তার জীবনের সবচেয়ে মজার জন্মদিন।
পরদিন আমাদেরকে নেওয়া হলো কলোনিয়াল উইলিয়ামবার্গস (Colonial Williamsburg Museum) মিউজিয়ামে। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লিভিং হিস্ট্রি মিউজিয়াম। ৩০১ একর জমির উপর এই মিউজিয়ামটি। এখানে ২০০ বছর আগের আমেরিকার লাইফ স্টাইল দেখানো হয়। সবকিছু ২০০ বছর আগেকার মত করে সাজানো। সবাই হাঁটছে, বাজার করছে, ঝগড়া করছে, নাটক করছে, কাজ করছে, ব্যবসা করছে, সবই নাটক মানে সাজানো। কিন্তু লাইভ। খুব ভালো লাগছিল, মনে হচ্ছিল আমি টাইম মেশিনে করে ২০০ বছর পিছনে চলে এসেছি। দীর্ঘ এলাকা হেঁটে দেখতে দেখতে পা ব্যাথা হয়ে গেল। আপনি অর্ধেক দেখে বের হয়ে যাবেন তার উপায় নাই। কারণ বের হবার জন্য গেট হচ্ছে শেষ প্রান্তে।
পরদিন আমাদেরকে একটা ওয়ার মিউজিয়াম নিয়ে গেল। সেটাও ভার্জিনিয়াতে। এই ওয়ার মিউজিয়াম যে যুদ্ধের উপর নির্মিত সেই যুদ্ধের নাম আমার এখন ঠিক মনে নেই। টিকেটের মূল্য ৩০ ডলার । ঢুকে মনে হলো আমাদের দেশের একটা ছোট গ্রামে ঢুকেছি। ভিতরে ছোট একটা গ্রামের দৃশ্য। মুরগী ঘুরছে, ছনের ঘর, লাইভ করে রেখেছে আর এটা দেখার জন্য ৩০ ডলার টিকেট! আহা এর চেয়ে অনেক সুন্দর দৃশ্য আমাদের গ্রামে আজও বিদ্যমান।
বুঝলাম ওরা কত যত্ন করে ওদের ঐতিহ্য রক্ষা করে চলছে। কথাটা মনে হয় এভাবে বললে ভালো হয় ওরা ওদের ঐতিহ্য পুজিঁ করে ব্যবসা করছে। আমার মনে একটা স্বপ্ন ভেসে উঠল। আমাদের কত সমৃদ্ধ প্রাচীন ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আছে। তার কিছু কিছু জাতীয় যাদুঘরে দেখা যায়। এগুলো দিয়ে যদি আমেরিকার মত লিভিং হিস্ট্রি মিউজিয়াম করতাম তাহলে কতই না ভালো হতো!
যেমন- ঢেঁকি দিয়ে ধান ভেঙ্গে চাল করে তারপর রান্না করা, পলো দিয়ে মাছ ধরা, গরুর গাড়িতে করে যাতায়ত, মসলিন শাড়ী বোনা, নৌকায় করে যাতায়ত এমন কত শত ঐতিহ্য এবং গৌরবের ইতিহাস আমাদের রয়েছে। হয়ত একদিন এমন লাইভ মিউজিয়াম করে এক সময়ের বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা হবে। যারা আমাদের দেশে বেড়াতে আসবে তাদের জন্য এটা খুব উপভোগ্য হবে। তারা জানবে আমাদের দেশ কত সুন্দর ছিলো, কত বৈচিত্র্যময় ছিলো।