আটলান্টা জর্জিয়া প্রদেশে অবস্থিত। কোকা কোলার জন্মস্থান এই আটলান্টায়। এর হেড অফিস ছাড়াও দেখার মতো অনেক কিছু রয়েছে। আমেরিকার সবচেয়ে বড় অ্যাকুরিয়াম রয়েছে এই আটলান্টায়। আমাদের সময় খুব সংক্ষিপ্ত হওয়ায় এর কিছুই দেখার সুযোগ হয়নি। তবে আমার স্বামীর অফিসিয়াল ট্যুর ছিলো আটলান্টায়। তিনি অনেক কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।
পরদিন অর্থাৎ ২৩ তারিখ ভোরবেলায় আটলান্টার উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। আমাদের পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে কিছু গাড়ি অনেক জোরে জোরে চালাচ্ছিল। একটা গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে খুব জোরে চলে গেল একটু পরে গিয়ে দেখি ঐ গাড়িটা উল্টে আগুন ধরে গেছে।
চোখের সামনে এমন ঘটনা থেকে নিজেরা আরো সর্তক হলাম। ৮ ঘণ্টা ড্রাইভ করে আমরা আমাদের আত্নীয়ের বাসায় পৌঁছালাম। আবহাওয়াটা তেমন ভালো ছিল না। কোথাও যাওয়ার মতো সুযোগ ও পরিস্থিতি ছিলো না। আশে পাশে একটু ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে মাত্র।
রাতটা কাটিয়ে পরদিন ভার্জিনিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আটালান্টা থেকে আমাদের পেন্টাগণ সিটির বাসার দূরত্ব ছিল ৬৩৫ মাইল, মানে ১০২২ কিঃমিঃ। স্বাভাবিক ড্রাইভ টাইম প্রায় ১০ ঘন্টা। দিনের আলোয় পৌঁছাতে হলে ভোরে রওনা দিতে হবে। এমনিতেই একটানা সাত দিনের ট্যূর শেষে আজ অষ্টম দিনে আমার স্বামীর শরীর কিছুটা ক্লান্ত। তার উপর রাতে ভাল ঘুম হয়নি কিন্তু আমাদের আজই ফিরতে হবে।
কারণ আমার স্বামীর একজন কলিগ সান দিয়েগো, ক্যালিফোর্নিয়াতে করছেন। তিনি ছুটিতে এসেছেন। তাকে আগে থেকেই আমরা বাসায় দাওয়াত দিয়ে রেখেছিলাম। তাই আমাদেরকে ফিরতেই হবে।
লং ড্রাইভে আমি সবসময় সেকেন্ড সিটেই বসি। এই দীর্ঘ ড্রাইভিং এর সময় আমি ভীষণ ক্লান্ত থাকলেও একবারও চোখ বন্ধ করতে পারি না। পাশে বসে ওকে একটু পর পর বাদাম, চুইং গাম, কফি দিয়ে তার ড্রাইভিং এর সময় জেগে থাকার এবং ড্রাইভ করার উৎসাহ দেই। যদিও উনি ড্রাইভিং সব সময় খুব উপভোগ করত। সেদিন ও তার ব্যতিক্রম ছিলনা।
সেদিন তাকে ড্রাইভং এর সময় বেশি মনোযোগী হতে হয়েছিল। কারণ রাস্তার বেশিরভাগ ছিল বরফে ঢাকা। আটলান্টা থেকে রওনা দেবার ঘন্টা দুয়েক পর পূর্ব ভার্জিনিয়ার তুষারাচ্ছন্ন এলাকাতে ঢুকলাম। বিশাল এলাকা জুড়ে রাস্তার দুধারে ফরেস্ট। গাছের পাতা থেকে নিচ পর্যন্ত বরফ ঝুলে আছে। মাঝে সমতল সরু সাদা এলাকাটা রাস্তা বলে ধরে নয়ে ড্রাইভিং করছে।
এখানে নেই কোন বাড়িঘর। তাই শহরের রাস্তাগুলোর যেভাবে স্নোপ্লাউ করে চলাচলের উপযোগী রাখা হয়, এখানে তার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া, এত বিশাল এলাকা স্নোপ্লাউ করার মত বাজেটও কোন রাজ্যের নেই। শুধু দুই-আড়াইশ মাইল পর একটা গ্যাস ষ্টেশন আছে, সেখানে গিয়ে তেলের টাঙ্কি ভর্তি করে, হালকা খাবার এর ব্রেক নিয়ে আবার চলা শুরু।
অনেকক্ষণ পর পর একটা দুইটা গাড়ি বিপরীত দিক থেকে আসতে দেখা যায়। তারাও মনে হয় আমাদের মত বাধ্য হয়ে এমন ঝুঁকিপূর্ন এলাকা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারা সব সময়ের মত পিছনের সিটে ঘুমাচ্ছে। আমি পাশের সিটে বসে তাকে জাগিয়ে রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত আছি।
মাঝে মাঝে যখন ভাবি এমন নির্জন এলাকায় – আল্লাহ মাফ করুক, যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে, তাহলে বুঝি আর কোন রক্ষা নেই। তবে একথা মুখ দিয়ে বলে বিপদকে আমন্ত্রণ জানাতে চাইনা।
প্রায় ৮ ঘন্টা ড্রাইভিং এর পর পূর্ব ভার্জিনিয়ার শহর এলাকা পেয়ে কিছুটা স্বস্তি হল। পশ্চিম ভার্জিনিয়া ওয়াশিংটন ডিসি’র পাশ্ববর্তি হওয়ায় সেখানে শহুরে এলাকা এবং মানব বসতি অনেক বেশি। তবে পূর্ব ভার্জিনিয়াতে বেশির ভাগ ফরেস্ট এলাকা বলে এখানে বন্য প্রানীদের রাজত্ব।
১৮ তারিখ থেকে তুষারপাত শুরু হয়েছিল তা তিন দিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দুই দিন এয়ারপোর্ট বন্ধ ছিল। ১১ ঘণ্টা পর রাত ৮ টায় পুরো সাদা ভার্জিনিয়া অবলোকন করতে করতে বাসায় এসে পৌঁছালাম।
এদিকে আমাদের মোবাইলের চার্জ শেষ। আজ রেন্ট এ কার এর শেষ দিন। তাই রাত ১২ টার আগে গাড়ি ফেরত দিতে হবে। যে ভাইয়ের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে গাড়ি রেন্ট নিয়েছি, তিনি আমাদেরকে ফোন দিয়ে পাচ্ছেন না। এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় যদি কোন অঘটন ঘটে তাহলে একদিকে আমরা তার বন্ধু পরিবার, অন্যদিকে সময়মত কার ফেরত দিতে না পারলে তিনি ক্রেডিট কার্ড ডিফল্টার হবেন।
আমেরিকাতে একবার ক্রেডিট ডিফল্ট করলে তাকে সারা জীবন তার খেসারত দিতে হয়। যাহোক, সব দুর্যোগ পেরিয়ে, আনুমানিক রাত ৮ টার দিকে যখন বাসায় পৌঁছাই। আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি নিরাপদে পৌঁছতে পারার জন্য।
আমার স্বামী আমাদেরকে বাসায় নামিয়ে আর দেরি না করে গ্যাস স্টেশন থেকে ফুয়েল ট্যাঙ্ক ভর্তি করে রেন্ট এ কার এ গিয়ে গাড়ি ফেরত দিল। সেখান থেকে সে ভাইকে ফোন দিয়ে জানাতেই বুঝল তিনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।