আমার দৃষ্টিতে স্বপ্নের দেশ-১ | স্বপ্নের দেশ “আমেরিকা”

স্বপ্নের দেশ “আমেরিকা”

অবশেষে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৬ই জুলাই ২০০৯ দিবাগত রাত ২ টায় অর্থাৎ পঞ্জিকার হিসাব মতে ১৭ই জুলাই উড়াল দিলাম আমি, আমার স্বামী, আর আমাদের দুই ছেলে-মেয়ে। গন্তব্য-“স্বপ্নের দেশ আমেরিকা”।

আমার স্বামীর প্রায় এক বৎসরের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য সপরিবারে আমন্ত্রণ থাকায় আমাদের ভিসা পেতে কোন সমস্যা হয়নি। তবে, আমার স্বামীর টিকেট আমেরিকার সরকারের খরচে, আমারটা বাংলাদেশ সরকারের খরচে, আর ছেলে-মেয়েদের টিকেট আমাদের নিজেদের খরচে হওয়ায় সবার টিকেট এক সাথে কাটা নিয়ে কিছুটা ঝামেলা হয়েছিল। যাহোক, শেষ পর্যন্ত একসাথে টিকেট পাওয়া গেলেও পশ্চিম দিকের বিমানে না গিয়ে পূর্ব দিকের বিমানে রওয়ানা দিতে হলো। এতে আমাদের ভ্রমন সময় প্রায় ৫ ঘন্টা বেড়ে গেল।

যখন বিমানে বসলাম, যাত্রা শুরুর আগ মূহুর্তেও আমি বুঝতে পারছিলাম না, কেন সবাই স্বপ্নের দেশে যাওয়ার জন্য বিভোর হয়? এমন কি আছে যার কারণে সকলের কাছে তা স্বপ্নের মত? কেন আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের মানুষদের সারা জীবনের স্বপ্ন থাকে এই স্বপ্নের দেশকে ঘিরে?

আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করতে থাকলাম, আর মনে মনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ধন্যবাদ জানালাম আমাকে এমন সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। ভাবলাম সুবহান আল্লাহতায়লা যখন আমাকে একবার সুযোগ দিয়েছেন আমি খুঁজে বের করব আমার উত্তর।

আমরা প্রায় ১ বছর থাকব। তাই আমাদের অনেক কিছু দেখার এবং জানার সুযোগ আছে। স্বপ্নের দেশের গভীরতা আমি খুঁজে দেখব। মনে মনে ঠিক করলাম যতদিন আমেরিকায় মানে স্বপ্নের দেশে থাকব ততদিনে আমি খুঁজে বের করব কেন মানুষ আমেরিকাকে “স্বপ্নের দেশ” বলে।

আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি ডালাস বিমানবন্দর। পৌঁছাতে ৩০ ঘন্টা সময় লাগবে এবং মাঝে ২টা ট্রানজিট সহ মোট ৩ বার বিমান বদলাতে হবে। প্রথম যাত্রা হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে শুরু। ৫ ঘন্টা পর আমাদের প্রথম ট্রানজিট হংকং এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালাম। জীবনে প্রথম কোন বিদেশী বিমানবন্দর দিয়ে পার হচ্ছি। এরাইভেল থেকে ডিপারচার লাউঞ্জে প্রবেশের পথে একে একে আমার পরিবারের সব সদস্যদের চেকিং এর পালা শেষ।

এবার আমার পালা। বডি স্ক্যানিং মেশিনের ভিতর দিয়ে প্রবেশের সাথেই কু কু শব্দ করে উঠল। আমার জুতাতে ধাতব কিছু ছিল বলে মনে হয় এই রকম শব্দ হতে পারে। তাই আমাকে দ্বিতীয়বার স্ক্যানিং মেশিনের ভিতর দিয়ে যেতে হলো। তার পরও অনেকক্ষণ ধরে নিরীক্ষণ শেষে মহিলা পুলিশ দিয়ে দেহ তল্লাশি করা হলো। অবশেষে ছাড়া পেলেও আমাদের হাতব্যাগে ব্যবহারের কিছু ছোট লোশন, কসমেটিক্স  ছিল, সেসব ফেলে দিল।

হংকং বিমানবন্দরের কথা অনেক শুনেছি, কিছু ছবিও বের হয়েছে এই বিমানবন্দর নিয়ে। সেখান থেকে সকলেই জানে এই বিমানবন্দরে কেমন কড়াকড়ি হয়। আজ নিজে প্রমাণ নিয়ে গেলাম। ৪ ঘন্টা যাত্রা বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু করলাম। তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ফেরার পথে যেন হংকং বিমানবন্দর হয়ে আসতে না হয় তেমন টিকিট কাটব।

এবারের যাত্রা অনেক দীর্ঘ। ২য় ট্রানজিট সানফ্রান্সিসকো। ১৩ ঘন্টার আকাশপথ পাড়ি দিতে হবে। সেজন্য তেমন কোন প্রস্তুতি নেই। জুলাই মাসে প্রচন্ড গরমের মাঝে বের হয়ে তেমন একটা শীতবস্ত্র সাথে নেইনি। তাই প্লেনে খুব ঠান্ডায় কম্বল গায়ে দিয়েও কাঁপতে হল। প্রথম বিদেশ ভ্রমণ, কত রকমের অভিজ্ঞতা অর্জন!

কিন্তু মজার ব্যাপার যখন আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে পৌঁছালাম তখনো ১৭ জুলাই সকাল। অবাক ও খুশী হলাম এই ভেবে যে বিমানে ৩ ঘন্টার ১ রাত, তারপর ১ দিন এবং ১ রাতের পর এখনও ১৭ জুলাই। অর্থাৎ বাংলাদেশে যে তারিখ ছিল, ২২ ঘন্টা পর আমেরিকা এসেও আমাদের কোন দিন হারাতে হয়নি। মানে জীবনে ১ টা দিন বেশী পাওয়া গেল!

স্বপ্নের দেশের মাটিতে প্রথম নামলাম। এখানে ইমিগ্রেশন শেষ করে বুকিং এ দেওয়া সব ব্যাগ আবার চেকইন করে আমাদের শেষ গন্তব্যের উদ্দ্যেশে রওয়ানা দিতে হবে। যেহেতু আমাদের ৪ জনের বিমানে ৮টা ফ্রি ব্যাগ ছাড়াও সরকারী খরচে আরো ৪টা ব্যাগ আনতে পেরেছি সেজন্য মোটামুটি প্রায় সব ধরনের মসলাপাতি, কিছু পোলাউর চাল, ডাল, ছোলা এসব প্রয়োজনীয় শুকনা খাবার আইটেম ব্যাগে নিয়েছিলাম।

স্ক্যানিং এ কাস্টমস পুলিশ সব খাবার সনাক্ত করতে সক্ষম হলো। কিন্তু ছোলা নিয়ে বাঁধল বিপত্তি। তাদের ধারণা হল, এটা একধরণের বীজ। যা কিনা আমেরিকার কাস্টমস আইনে প্রবেশ নিষেধ। অনেক কষ্টে তাদের বোঝানো গেল যে এটা কোন বীজ না, ডাল জাতীয় আমাদের এক ধরণের খাবার।

তবে ইমিগ্রেশন শেষ করে পরবর্তী যাত্রার আগে খাবার জন্য সাথে থাকা পানির বোতল আর কোমল পানীয় জমা দিয়েই চেকইন করতে হল।

বিমানের শেষ যাত্রা ৫ ঘন্টার। ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের বোর্ডিং কার্ড নিয়ে দেখি আমাদের পরিবারের ৪ সদস্যের আসন ৪ জায়গায় । ভেবেছিলাম বিমানে উঠে অন্য যাত্রীদের অনুরোধ করে আমাদের আসন একসঙ্গে করে নিব। কিন্তু উঠেই আমাদের সকলের মন খারাপ হয়ে গেল।

কারণ আমাদের সিটগুলো একটা থেকে আরেকটা অনেক দূরে দূরে। এক লাইনে ৩ জনের আসন। আমার বাচ্চারা খুব বেশি বড় নয়। তাই ওদের বাবা ২ জনকে অনুরোধ করে যেন উনারা আমাদের সাথে আসন পাল্টিয়ে বসে। একজন রাজী হয়েছে আর অন্যজন রাজী হলোনা। অবশেষে ওদের ২ ভাইবোনকে একসাথে বসিয়ে আমরা ২ জন আলাদা দুই আসনে বসলাম।

আমার আসনটি ছিল ৩ জনের মাঝে। খুবই অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি। আসনগুলো ছিল খুবই সংকীর্ণ। পা টাও মেলে বসার মত অবস্থা নেই। তার উপর যদি দুপাশেই থাকে আমার চাইতে দ্বিগুন কেউ তবে মাঝের জনের কি অবস্থা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই!

আমাদের মফস্বলের বাসগুলোর অবস্থা এর চাইতে অনেক ভালো। শুনেছিলাম আমেরিকার আভ্যন্তরীন বিমানগুলোর মধ্যে এটা বেশ নামকরা তারপর ও এরকম অবস্থা!

পেট জানান দিলো তার খাদ্য চাই। জানতে পারলাম ৫ ঘণ্টার এই যাত্রায় বিমান কোন খাবার সরবরাহ করবে না। কিনে খেতে হবে! অবাক হলাম। খাবার অর্ডার করলাম কিন্তু পেমেন্ট নিয়ে বাঁধল বিপত্তি। ক্যাশ নয় তারা ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট নেয়। কিন্তু আমাদেরতো ক্রেডিট কার্ড নেই! তাহলে কী না খেয়ে থাকতে হবে?

আমি প্লেনের জানালায় বাইরে তাকাই, ঝলসানো রুটি দেখার আশায়। কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদ তো দেখি না। এলোমেলো মেঘ ছাড়া! হায় সপ্নের দেশ আমেরিকা, তোমার আকাশে আমি ক্ষুধার্ত হয়েই উড়ে বেড়াই!”

তারা ব্যাপারটা বুঝলো, কিন্তু তাদের কাছে কোন সমাধান নেই। অবশেষে এয়ার হোস্টেজ তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে এসে জানাল “তারা বিল কোন মতেই নগদে নিতে পারবে না, তাই আমাদের খাবারটা তারা শুভেচ্ছা স্বরূপ আমাদেরকে দিয়েছে!”

আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের আভ্যন্তরীণ বিমানে ৩০ মিনিটের যাত্রাপথেও একটা ভাল মানের খাবার প্যাকেট আর একটা পানি দেয়। আর বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশের এমন নিয়ম! একটা তফাৎ পেলাম স্বপ্নের দেশ আর আমার সোনার দেশের মধ্যে-তাহলো আতিথেয়তায়। এবং অবশ্যই আমরা এখানে বৃহৎ মনের পরিচয় বহন করি।

অবশেষে, দীর্ঘ ৩০ ঘন্টার যাত্রার পর ওয়াশিংটন ডালাস বিমানবন্দর এসে পৌঁছালাম তখন ১৭ জুলাই রাত আটটা। হিসেব করে দেখলাম ৩৬ ঘণ্টার একদিন পেলাম!

Leave a Comment