পর্ব-১
কলমেঃ মহিউদ্দিন আলমগীর
আলবেনী
কোরবানীর ঈদ ২০১৭, পরিবারের সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ঈদ একসাথে করবে। তবে জায়গা নির্বাচন করা কঠিন হয়ে গেল। কারণ ছোটভাই ও বোন সপরিবারে আমেরিকায় থাকে। কিছুদিন হল বড়ভাইয়ের ছেলে পেন ষ্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তাই আমেরিকা না বাংলাদেশে করবে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। শেষপর্যন্ত আমেরিকায় ঈদ করার পাল্লা ভারী হয়ে উঠল।
ঈদের দিনকয়েক আগে পৌঁছালাম জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে। আমেরিকা বলতে সবার চোখে ভেসে উঠে নিউইয়র্কের ছবি। ভেসে উঠে অসংখ্য উঁচু ভবন আর ষ্ট্যাচু অব লিবার্টি। যদিও ষ্ট্যাচু অব লিবার্টি আমেরিকার তৈরী না, তবুও এটা আমেরিকার প্রতীক হয়ে গেছে। আমেরিকার স্বাধীনতা উপলক্ষ্যে এটি ছিল ফরাসি রাজার উপহার। ফ্রান্সে তৈরী হওয়ার পর, এটি জাহাজে করে আমেরিকায় পাঠানো হয়।
এয়ারপোর্ট থেকে প্রথমেই গেলাম নিউইয়র্কের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনালে। এটাই নিউইয়র্কের বাস ও ট্রেনের জন্য কেন্দ্রীয় টার্মিনাল।
এখান থেকে বাসে চড়ে যাব আলবেনী, আমার ছোটভাই পরিবারসহ এখানেই বসবাস করে। নিউইয়র্ককে সারা পৃথিবীর রাজধানী বলা হলেও, নিউইয়র্ক কিন্তু খোদ নিউইয়র্ক রাজ্যেরও রাজধানী না! এর রাজধানী হল আলবেনী, নিউইয়র্ক শহর থেকে সুজাসুজি উত্তরে। আলবেনী যেতে বাসে দুইঘন্টা লাগল। দীর্ঘ বিমান ভ্রমনের কারণে ক্লান্ত ছিলাম, সবাই বাসে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
বড় ভাই গতকাল পৌঁছে গেছে পেন ষ্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছেলে লাবিবের কাছে। সেখান থেকে আজ আলবেনী আসার কথা। ছোটবোন তাঁর পরিবারসহ আসবে ফ্লোরিডা থেকে। সবাই উঠব আলবেনী ম্যারিয়ট হোটেলে। কি করব, বাসায় তো আর আঠারো জনের সংকুলান হবেনা!
কর্মের প্রয়োজনে অনেক দেশেই গিয়েছি, অনেক হোটেলেই থেকেছি। কিন্তু আমেরিকার হোটেলের মত এত বৈচিত্র্যহীন ও নিরানন্দ হোটেল আর কোথাও দেখি নাই। লবিতে পৌঁছে দেখি ফাঁকা! চেক ইন করবো তারও উপায় নাই। কোন মানুষজন নেই, শুনশান নীরবতা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলাম। একসময় পেয়ে গেলাম একজনকে।
খাবারের আনন্দ
রাতে সবাই এক হলাম হোটেল লবিতে। এরমাঝে ছোটবোন তাঁর স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে উঠে পড়েছে এখানে। বড়ভাই স্বপরিবারে পেনসেলভেনিয়া থেকে তাঁর আগেই উঠেছে এখানে। ছোটভাই পরিবার নিয়ে হোটেলে দেখা করতে আসলো। দীর্ঘদিন পর সব ভাইবোন একসাথে হলাম। একদা ছোট এক সরকারী ভবনে একসাথে থাকতাম, আর আজ সবাই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মিলনমেলা দ্রুতই আনন্দমেলায় রূপ নিল।
ডিনারের সময় হয়ে গেছে, সবাই মিলে গেলাম জাপানি এক রেস্টুরেন্টে। ডিনার খেতে জাপানি ফুড ছিল সবার পছন্দের, খাবারের নাম হিবাচী।
এটা শুধুমাত্র খাওয়া নয়, একধরনের বিনোদনও। কাউন্টারের মত বসার জায়গা, মাঝে কিচেন। চোখের সামনে রান্নাবান্না চলছে, আর আমরা শেফকে ঘিরে তাঁর কর্মযজ্ঞ দেখছি। রান্না তো নয় যেন জীবন্ত মার্শাল আর্ট। দেখেই মনে ভরে যায়!
অনেক আগে ইস্তানবুলের চত্বরের কথা মনে পড়ল। এক বিকেলে হেঁটে বেড়াচ্ছি সেখানে। ব্রীজ দিয়ে বসফরাস প্রণালী পার হয়ে এসেছি। কিন্তু কোন পাশে আসলাম, ইউরোপ থেকে এশিয়া, না এশিয়া থেকে ইউরোপের দিকে তা মনে নাই! শুধু খেয়াল আছে, যে পাশে একজন মানুষ মোমের ডানা মেলে আকাশে উড়তে চেয়েছিল সেই পাশে। উপর থেকে ঝাঁপ দেয়ার পর মানুষটি ডানা মেলে দেখে, ডানা কাজ করছেনা। শূন্যে থাকা অবস্থায় বুঝতে পারল তাঁর আবিষ্কার কাজ করছে না! ব্যাপারটা ভয়ংকর। অনেক আগে ঘটে যাওয়া এ ঘটনার স্মরণে, একটা স্মৃতিসৌধ আছে সেখানে।
একটি চত্বরের কথা খেয়াল আছে, যেখানে থরে থরে আইসক্রিমের দোকান। গরমের সময় তাই ঠান্ডা খেতে ইচ্ছা করল। চত্বরের পাশেই এক আইসক্রিমের দোকানে গেলাম। বিরানীর দোকানের মত বিভিন্ন রঙের বাক্সে আইসক্রিম সাজানো। হাতে আছে ডেকচিতে রান্না করার মতো লম্বা হাতলওয়ালা গোল চামচ। চামচের সাইজ কিন্তু ছোট।
অর্ডার করতেই, দূর হতে হাতলের সাহায্যে আইসক্রিমের কোণ ধরিয়ে দিল। ধরলাম কোণ, এবার আইসক্রিমে দিবে। দিল আইসক্রিম, উঁচু করতেই তাঁকিয়ে দেখি কোণটি নাই। তাকালাম দোকানির দিকে! সে কোনটি আবার দিল, ধরলাম আমি শক্ত করে। এবার আইসক্রিম দিল, হাত উঁচু করতেই বিস্মিত হলাম আমি, শুধু কোণটিই আছে হাতে। আইসক্রিমসহ আসল কোণটি তাঁর হাতে!
দোকানী হাসছে। ততক্ষনে অনেকেই আমাকে ঘিরে হাসছে। এবার খুব খেয়াল করে কোণটা ধরলাম, দোকানী আইসক্রিম দিল। হাতেই আছে কোণসহ আইসক্রিম। নিশ্চিত হয়ে শুরু করলাম, কিন্তু কোথায় আইসক্রিম! কোথায় কোণ! কিছুই নেই হাতে। বুঝলাম এবারও ধরা খেয়েছি। চারিদিকে হাসির রোল পড়ে গেলো! আমি বোকা হয়ে হাসতে লাগলাম!
ষ্টিক দিয়ে আইসক্রিম বিক্রেতারা এতোটাই পারদর্শী যে, সবাইকেই আমার মতো বোকা বানায়। এটাই আইসক্রিম বিক্রির ঐতিহ্য। বলিউড অভিনেতা আমির খান নাকি সম্প্রতি এসে আমার মতোই বোকা বনে গেছে। দোকানী এরপর আইসক্রিম হাতে দিলো, আমি আরেকটা হাত ঢাকনার মতো করে রাখলাম। এবার দোকানী হেসে উঠল।
আশেপাশের সবাই তালি দিয়ে উঠল। কিছুক্ষণ পর, একটু দূরে সরে গিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। ততক্ষণে পিছনে হাসির রোল পড়ে গেছে। ফিরে দেখি আরেক কাষ্টমারের আইসক্রিম ধরার ব্যর্থ চেষ্টা! না হেসে পারলাম না।
খাবার প্রস্তুতি শেষ, শেফ এবার একে একে সবাইকে খাবার পরিবেশন করা শুরু করল, ধোঁয়ায় চারিদিক ভরে গেছে। ফাঁকে ফাঁকে আগুন নিয়ে নানারকম কসরত দেখাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা তা দেখে খুবই মজা পাচ্ছ। বুড়ো শেফের হাসি দেখে মনে হল, বাচ্চাদের চেয়ে সে-ই বেশী মজা পাচ্ছে। পরিবেশনা শেষে বাচ্চাদের ফুল দিল তারপর জাপানী কায়দায় মাথা ঝুকিয়ে বিদায় নিল।
লেক জর্জ
পরের দিন সবাই মিলে আলবেনীর লেক জর্জ দেখতে গেলাম। দুই বছর আগে প্রথম যখন আলবেনী এসেছিলাম, সময়টা ছিল জানুয়ারির মাঝামাঝি। ছোটভাই ডঃ জহির, আমাকে নিয়ে গিয়েছিল লেক জর্জে। প্রচন্ড শীত, চারিদিকে শুধু বরফ দেখতে পাচ্ছি। বরফের মাঝে সব দৃশ্য একইরকম লাগে। নদী, লেক, মাঠ, শূন্য উদ্যান কিছুই আলাদা করে বোঝার উপায় নাই।
তেমনি পত্রহীন থাকায় আলাদা করা বন জঙ্গল বোঝার উপায় নাই। বিরামহীন একই দৃশ্য দেখে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। অপেক্ষায় ছিলাম কখন লেক জর্জে পৌঁছাবো। ছোটভাই একসময় গাড়ী থামিয়ে নেমে বললঃ
চলে এসেছি।
জিজ্ঞাস করলামঃ
কোথায়?
-লেক জর্জে।
দেখলাম চারিদিকের পাহাড় ছেয়ে আছে বরফে, পাহাড়ের মাঝে শেত শুভ্র বিশাল উপত্যকা। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এর চারিদিকেই বরফ, পানির কোন চিহ্ন নেই। গাছপালা সব পত্রশূণ্য, ঠায় দাঁড়িয়ে। বৈচিত্র্যহীন নিসর্গ।
সব দেখে জিজ্ঞাসা করলামঃ
লেক কোথায়?
ছোটভাই তখন হাত দিয়ে বরফের উপত্যকা দেখিয়ে দিল। দেখলাম, ছোটবড় বিভিন্ন সাইজের পিক আপ ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে!
বাইরে এত শীত যে, মোটা জ্যাকেট পড়া সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে থাকা যায়না। রাস্তাঘাটে লবন ছিটানো। দাঁড়িয়ে বরফ দেখার কোন মানে হয়না। তাঁকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। খাবারের মান ভাল ছিল। আমেরিকার এই একটা ব্যাপার বেশ ভাল, সবজায়গায় রেস্টুরেন্ট, আর সব রেস্টুরেন্টের খাবারের মান ভাল।
ফেরার পথে ছোটভাইকে বললাম, একটা কৌতুক বলি শোন,
একলোক ডাব চুরি করতে গাছে উঠেছে।
মালিক টের পেয়ে বললঃ
গাছে কে রে! গাছে কে!
লোকটি নামতে নামতে বললঃ
গাছে আমি।
-কি করো!
-ঘাস কাটি।
-গাছে কি ঘাস পাওয়া যায়? অ্যা ? গাছে কি ঘাস পাওয়া যায়!
গাছ থেকে নেমে লোকটি দাত বের করে হাসি দিয়ে বললঃ
এর লাইগাইতো নাইমা আইলাম!
তো রুশো (ছোটভাইয়ের ডাক নাম)! লেকে কি গাড়ি চলে! ছোটভাই গাছের সেই লোকটির মত হাসি দিয়ে বললঃ
এর লাইগাইতো চইলা আইলাম।
কথা শুনে দুজনেই হাসতে লাগলাম। বাকি পথ আমরা নানারকম রসিকতা আর গল্পগুজব করে ফিরে আসলাম।
এখন অটম বা হেমন্ত চলছে। প্রায় চার পাঁচ বছর পর আবার সেই লেক জর্জে যাচ্ছি। দুই আড়াই ঘন্টার পথ লেক জর্জ। তবে এখনকার যাত্রাপথ সম্পূর্ণ ভিন্নতর। কোনভাবেই আগের সেই যাত্রাপথের সাথে মিলাতে পারছি না। শীতে যে মৃত বনের মাঝ দিয়ে গিয়েছিলাম, আজ সেখানে সম্পূর্ণ রঙিন বন। নৈঃশব্দে ঠায় দাঁড়ানো ছিল পত্রবিহীন ম্যাপল বৃক্ষ, আজ তা পত্রবহুল সজীব। শুধু তাই নয় মাইলের পর মাইল পাতার রঙ গোলাপী, আবার মাইলের পর হলুদ, আবার কখনওবা তা লাল, কখনও মেরুন, কখনও রূপালী। ম্যাপল গাছের পাতার রঙ ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলায়। একেক ঋতুতে একেক রঙ ধারণ করে। আমরা বেশিরভাগ গোলাপী ও ঈষ্যৎ হলুদ রঙের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি। মাঝে সাঝে গাছের পাতায় গাঢ় রঙের ছোপ চোখে পড়ে। বাতাসের দোলায় তিরতির করে কেঁপে উঠে পাতারা, ঝিরিঝিরি শব্দ ছড়িয়ে দেয় আকাশে। পাশে কূলকূল শব্দে বয়ে চলে নদী, নানান স্বরে ডেকে উঠে পাখি।
নানান রঙ, নানান ধ্বণি এখন প্রকৃতিতে বিচরণ করে। প্রকৃতির এ খেলায় মুগ্ধ হলাম। রাস্তার পাশ দিয়ে নদী বয়ে যায়, নদীটির নাম হাডসন। এত স্বচ্ছ নদীর পানি আগে দেখিনি। দেখে সন্দেহ জাগে দুই বছর আগে নিশ্চয়ই আমার চোখে ছিল সাদাকালো, শ্রবণযন্ত্র ছিল নিষ্ক্রিয়। আজ চোখে রঙিন ফিল্ম পরানো, পাতার শব্দও ডিজিটালি ধারণ হচ্ছে।
চারিদিকে ফুরফুরে সতেজ ভাব দেখে মনে প্রফুল্লভাবের উদয় হয়, প্রাণে জাগে উচ্ছ্বাস। বড়ভাই বলল, শীতকাল শেষ হলে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এখানে বেড়াতে আসে প্রকৃতির এ রঙ দেখতে।
আমার বড়ভাই, আমেরিকা এসেই জেনারেল মোটরসের বিশাল একটা জীপ ভাড়া নিয়েছে। আট সিটের এ বিশাল গাড়িতে অনায়াসে দুই পরিবার ধরে যায়। ড্রাইভিং উনার ভীষণ প্রিয়, যদিও এখানে লেফট হ্যান্ড ড্রাইভিং, তবে এতে উনার সমস্যা হয়না, বেশ ভালভাবেই আয়ত্ব করে ফেলেছেন। ঘন্টার পর ঘন্টা ড্রাইভ করা কোন ব্যাপার না। আমাদের পিছনে আছে, ছোটভাই ও তাঁর পরিবার। তারও পিছে আছে ছোটবোনের পরিবার সাথে আম্মা।
এবার মন ভরে লেক দেখলাম। বেশবড় লেক, টলটলে তার পানি, বোট ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে। দেখে খুব মজা পেলাম। লেকের চারিদিকে গাছপালা, সাথে হাঁটার পেভমেন্ট কিছুদূর পরপর বেঞ্চ, আছে ছোট ছোট চত্বর। বেশ যত্ন করে ল্যান্ডস্কেপিং করা।
খাওয়া দাওয়ার পর বিকালটা কাটিয়ে দিলাম সেখানে। ছেলেমেয়েরা ছোটভাই ও বোনের দুই বাচ্চা নিয়ে আনন্দে মেতে রইল। সূর্য ডোবা পর্যন্ত, সময় কাটালাম আমরা।
রাতে হোটেলে ফিরছি। দুইঘন্টার ড্রাইভ, আমি বড় ভাইয়ের পাশে। মাঝে মাঝেই ঝিমুনি এসে যাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় পরে গেলাম আমি, শুধু এসেছি, ঘুরেছি আর খেয়েছি। একফোটা ড্রাইভ করিনি তাই আমার এই অবস্থা। আর উনি ড্রাইভ করে এসেছেন আবার ড্রাইভিং করে যাচ্ছেন। গতি নিম্নে একশত বিশ, যদি একটু ঝিমুনি আসে!
কাজেই বাকি রাস্তা সজাগ থাকার চেষ্টা করলাম। নানারকম কথাবার্তা বলতে লাগলাম, যাতে সবাই সজাগ থাকে। হঠাৎই শুনলাম কেউ যেন ডাকছে। দেখি আমার বড়ভাই! বাকীরা হাসছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা, কতক্ষণ তাও জানিনা! তবে এখন আছি হোটেলের পার্কিংয়ে! কপাল ভাল ড্রাইভিং সিটে ছিলাম না।
ঈদ উদযাপন
আগামীকাল ছোটভাইয়ের বাসায় ঈদ উদযাপন। ক্লান্ত সবাই, ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেক ভোরে উঠে, স্ত্রীকে নিয়ে বের হলাম। হোটেলের বাইরে অপেক্ষা করছি লিমুজিন সার্ভিসের জন্য। পাশেই ব্রেকফাষ্ট করব নামকরা একটি চেইনশপে। প্রথমেই ব্ল্যাক কফি খেলাম। বিদেশে এসে রং চা খেয়ে দেখেছি, ভাল লাগেনা। দুধ চা তো আরো না। তাই দুজনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিস্বাদ যখন খেতেই হবে, তাখন চরম বিস্বাদই ভাল।
ছোটভাইয়ের বাসায় সবাই আছি। মা এখানেই উঠেছে। সারা বাসা গমগম করছে। করবেই বা না কেন? রান্নাঘরে রাধুনীর অভাব নাই, টেবিলে খানেওয়ালাদের অভাব নেই। সমস্যা একটাই খাওয়া শেষ হয়না! ব্যাচের পর ব্যাচ চলতে থাকে।
অতঃপর একসময় শেষ হল। বড়ভাই সব ছেলেদেরকে একটা করে পাঞ্জাবি দিল, একই রঙের পাঞ্জাবি। এটা সে ঢাকা থেকে ক্যারি করে নিয়ে এসেছে। মেয়েরা সবাই আগে থেকেই শাড়ি পড়েছিল। এপার্টমেন্টের নীচে যেভাবে ল্যান্ডস্কেপ আর গার্ডেনিং করা তা আমাদের জাতীয় উদ্যানের চেয়েও সজ্জিত আর পরিচ্ছন্ন। সেখানে আমরা বাকি সময়টা গ্রুপ ছবি, পারিবারিক ছবি তুলে কাটিয়ে দিলাম। আমেরিকানরা হাঁটার পথে কৌতুহলে আমাদেরকে দেখে আর হাসে। কেউবা অবাক হয়ে হাই আর বাই দেয়।
পরের দিন আমরা বাচ্চাদের জন্য উৎসর্গ করলাম। প্রথমেই গেলাম একটা ইনডোর থিম পার্কে। নানারকম খেলাধূলা করতে লাগল ছেলেমেয়েরা। একপর্যায়ে যুদ্ধের খেলায় আমিও অংশগ্রহণ করলাম, গুলাগুলি করতে লাগলাম, অনেকজনকে মারলাম। যুদ্ধ শেষে স্কোরবোর্ডে দেখলাম আমার স্থান সবার নীচে। কি কারণে এমন হল বুঝতে পারলাম না। বাচ্চারা সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিল।
লাঞ্চের পর গেলাম আরেকটা ইনডোর পার্কে। সেখানে আরও মজা! লাফ দিলেই নীচের কাপড়টা স্প্রীংয়ের মতো মানুষকে শূন্যে তুলে দেয়। কয়েকবার ডিগবাজী খেলাম, তাই দেখে ছেলেমেয়েরা খুব আনন্দ পেল। বাচ্চাদের লাফালাফি দেখে আমরাও আনন্দ পেলাম। খেলার সময় শেষ, ছেলেমেয়েদের মন খারাপ হয়ে গেল। সবাই হোটেলে চললাম।
নায়াগ্রার উদ্দেশ্যে
ঈদের দুইদিন পরের সকাল, আমরা যে যার মত চলে যাব, এটা নিয়ে কারও ভাবার সময় নেই। এ যুগে বিদায়ের সময় কেউ বিষন্ন থাকে না বরং আনন্দের অনুভুতি নিয়ে চলে যায়। ব্রেকফাষ্ট শেষে যে যার মতো রওনা দিল, ভাবটা এমন যেনো অফিস করতে যাচ্ছে। আমরা রয়ে গেলাম। আমাদের পরিকল্পনা হল নিউইয়র্কে দুইদিন থেকে বাংলাদেশে চলে যাব। এখান থেকে নিউইয়র্ক বাসে যাব, একঘন্টা পরপর বাস ছাড়ে। তাই তাড়াহুড়া করলাম না, ধীরে সুস্থে যাব। প্রবাসী বন্ধু শফিককে কল করলাম।
-কি খবর?
-বললাম, ভাল আছি। এখন আলবেনীতে, একটু পরে নিউইয়র্ক রওনা দিব।
-কবে আসলি?
-ঈদের আগে।
-জানালি না তো!
-তোর ওখানে এসে বাকিটা বলব।
শফিক আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। সস্ত্রীক আমেরিকা থাকে দীর্ঘদিন। এর আগে আমারা নিউইয়র্ক এসে ওর সাথে দেখা করেছিলাম। ওর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোটবড় অনেকের সাথেই দেখা হয়েছিল। শফিক বললঃ
এক কাজ কর নায়াগ্রা ঘুরে আয়। তোর ওখান থেকে কাছেই। এখন আবহাওয়া ভাল, নায়াগ্রা দেখার উপযুক্ত সময়। আবার কখন আসবি তখন হয়তো এরকম আবহাওয়া থাকবে না।
বললামঃ
তোর ওখানে আসব আর তুই রাস্তা ঘুরিয়ে দিচ্ছিস কেন?
-তুই ঘুরে আয়। পরে দেখা হবে।
-ঠিক আছে।
চলে গেলাম ট্রেন ষ্টেশনে। অ্যামট্র্যাকে টিকিট কাটলাম, আলবেনী টু বাফেলো। আলবেনী থেকে পশ্চিম দিকে সুজাসুজি একটা সরলরেখা টানলে যেখানে প্রথম কানাডার বর্ডার স্পর্শ করে, সেটাই বাফেলো। এখান থেকে ছয়ঘন্টা লাগবে বাফেলো সিটিতে পৌঁছতে। এগারটায় ট্রেন, সময় নাই। দৌড়ে গেলাম প্লাটফর্মে, ট্রেন ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন দেখে সেই ছিয়াশি সালে চলে গেলাম। ‘দ্য ফল গাই’ সিরিয়াল তখন জনপ্রিয়! সিরিয়ালের শুরুতে ট্রেইলরে দেখতাম একটা ট্রেনের সাথে ক্রসিংয়ে একটি গাড়ির সংঘর্ষ। এটা সেই ট্রেন না হয়েই যায় না!
এতদিন পার হল, এতো পরিবর্তন হল, কিন্তু ট্রেনের চেহেরা একই রয়ে গেল! পরে ছোটভাইয়ের কাছে শুনেছি আমেরিকানরা এটাকে তাঁদের ঐতিহ্য মনে করে, তাই পরিবর্তন করেনা!