আমেরিকার পেন্টাগন সিটির বাসা
মালপত্র নিয়ে বের হতে যাব, তখনি দেখি আমাদের নামসহ প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঝ বয়সী দীর্ঘাকার একজন আমেরিকান মহিলা। আমরা এগিয়ে আসতেই পরিচয় দিলেন, “আমি শ্যারন, আপনাদের হাউস লিজিং এজেন্ট”।
শ্যারন আমাদের সব ব্যাগ নিয়ে তার বড় একটা ভ্যানের পিছনে রাখল। অবাক লাগলো এতো ভারী ভারী ব্যাগ সে একাই তুললো। তারপর আমাদেরকে তার গাড়ীতে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং করে নিয়ে আসল ভার্জিনিয়ায়। আমাদের বাসা দেওয়া হয়েছিল ভার্জিনিয়াতে। আমার স্বামীর কোর্সের স্থান ছিলো ওয়াশিংটন ডিসিতে।
বিমানবন্দর থেকে বাসা ৪০-৪৫ মিনিটের দূরত্ব। গাড়িতে বসে বাসার উদ্দ্যেশে রওয়ানা দিলাম। চারদিক খুব ভালো করে দেখতে লাগলাম আর বারবারই মনে হলো আমাকে বের করতেই হবে কেন মানুষ এখানে আসার জন্য ব্যাকুল? কেনইবা এটা সকলের কাছে স্বপ্নের দেশ?
বাসায় যাওয়ার পথে শ্যারণ বলল বাসায় হালকা পানীয় আর শুকনা খাবারের ব্যবস্থা আছে। তবে, তোমাদের নিশ্চয়ই রান্নার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে হবে? চল তোমাদেরকে একটা শপে নিয়ে যাই।
সে আমাদেরকে ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে এমন একটা মেগা সুপার শপে নিয়ে গেলেন। যার নাম ‘হ্যারিস টিটার’। আমি সবকিছুর দাম দেখে ডলার থেকে টাকায় হিসাব করে চমকে যাই। কিনতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ি। একটু পর ভাবলাম এভাবে দাম দেখে ভাবলে কিছুই কেনা হবে না। টাকার হিসাব ভুলে যেতে হবে। আমেরিকাতে যে জিনিসের যা দাম আগামী একবছর তাই দিয়েই তো কিনতে হবে। তাই রান্নার জন্য প্রয়োজন হতে পারে এরকম প্রায় সব ধরণের গ্রোসারিজ, তাজা শাক-সবজি, ফল, মুরগী, রেডিমেড সামগ্রী সব নিয়ে কার্ট ভর্তি করলাম। কোন কিছুর দামের দিকে তাকালাম না। আমাদের প্রথম কেনাকাটার দামটা একটু বেশীই দিতে হলো। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জানতে পারলাম, হ্যারিস টিটার হচ্ছে ওখানকার সবচেয়ে দামী সুপার শপ। একটু অন্য দিকে আরও কিছু সুপার শপ আছে, যেখানে আরও কম দামে কেনা কাটা করা যায়। এটা ছিল আমেরিকাতে আমাদের প্রথম শিক্ষা। Open Economy’র বদৌলতে সবাই নিজের ইচ্ছামত জিনিসপত্রের দাম বসাতে পারেন। একই জিনিসের দাম একেক মার্কেটে একেক রকম। গায়ে কোন কোম্পানী মূল্য লেখা থাকে না।
যখন বাসায় পৌঁছি তখন রাত ১টা। আমেরিকার আমার প্রথম ভালো লাগা বাসায় পা দিয়ে। মনে হলো সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। ছিমছাম, সাজানো-গুছানো সুন্দর একটা বাসা। আমাদের আগে কেউ ঐ বাসায় উঠেনি। ৩ বেডরুমের বড় একটা বাসা। সব রুমের ফ্লোর নতুন ঝকঝকে ওয়াল টু ওয়াল মোটা কার্পেট মোড়ানো। সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম, সবধরণের ফার্ণিচার, বেডিংপত্র, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, এবং বাসার প্রয়োজনীয় সব ক্রোকারিজ, জিনিসপত্র দেখে সত্যি তৃপ্ত হলাম – আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করলাম। সেদিনের মত হালকা গোছগাছ করে কিছু রেডিমেড খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমাদের বাসা ছিল পেন্টাগণ সিটিতে ‘গ্রামারছি’ নামক নতুন ১৮ তলা বিল্ডিংয়ের একটি কর্ণার অ্যাপার্টমেন্ট। আমেরিকার সশস্ত্র বাহিনী হেডকোয়ার্টার পেন্টাগণের খুব কাছেই। আগে পেন্টাগনের আশে পাশে আবাসিক ভবন তৈরী হতনা। কিন্তু ৯/১১ এ পেন্টাগনের উপর যাত্রীবাহী বিমানের আঘাতের পর এর সুরক্ষার জন্যই আশে-পাশে উঁচু বিল্ডিং নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেজন্য আমেরিকার পেন্টাগণ সিটির বাসা বাড়তি গুরুত্ত্বপূর্ণ এবং অভিজাত এলাকা বলা চলে।
পরদিন রাঁধতে গিয়ে দেখি হ্যারিস টিটার থেকে এতকিছু কিনলাম, কিন্তু আসল জিনিস মানে লবণই কেনা হয়নি। আমার স্বামী ছেলেকে সাথে নিয়ে লবণের উদ্দেশ্যে বের হলো। এদিকে আমার রান্না প্রায় শেষ পর্যায়ে কিন্তু লবণের দেখা নাই। এক ঘন্টা-দুই ঘন্টা-অবশেষে প্রায় তিন ঘন্টা পর লবণের দেখা পাওয়া গেল।
ঐ সুপার শপটা ছিল বাসা থেকে ১০-১৫ মিনিটের পায়ে হাঁটার রাস্তা। কিন্তু তারা ওই সুপার শপের কাছাকাছি গিয়েও খুঁজে না পেয়ে এদিক ওদিক ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমেরিকাতে প্রথম দিন বলেই তাদের ওই অবস্থা। রাস্তা সবগুলো দেখতে প্রায় একই রকম। রাস্তার নাম-নম্বর মনে না রাখলে বিপদ মানে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।
যা হোক লবণ আসার পর দুপুরে খাবার খেয়ে ক্লান্তিতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। এরপর একজন একজন করে রাত ১ টা থেকে ২ টার দিকে আবার ঘুম থেকে উঠা শুরু হলো। হিসেব করে দেখলাম এখনও আমরা বাংলাদেশের টাইম জোনে আছি, যাকে বলে জেট ল্যাগ। পৃথিবীর এক পৃষ্ট থেকে আরেক পৃষ্টে যাবার পর আগের অভ্যাস পরিবর্তন হতে কয়েকদিন সময় লাগে। এভাবে কয়েক দিন চলল।
আমাদের সাথে ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান থেকে যারা এসেছিলেন তাদেরকেও বলতে শুনেছি যে তাদেরও রাতের পরিবর্তে দিনের বেলায় লম্বা ঘুম আসে। ধীরে ধীরে আমেরিকার সময়ের সাথে মানিয়ে নিলাম।
আমাদের বাসার আশেপাশে ছিল চওড়া রাস্তা আর ছিমছাম ফুটপাত, যা ধরে আমরা প্রায় প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে বের হতাম। তখন সন্ধ্যা হতো প্রায় সাড়ে আটটায়। তাই দীর্ঘ হাঁটাহাঁটি করে আশেপাশের জায়গাগুলো চিনে নিতে লাগলাম। সবকিছু অনেক গুছানো। বিশেষত ওদের সড়ক ব্যবস্থা খুবই উন্নত। ওরা ফুটপাত দিয়ে পায়ে হাঁটা ছাড়াও বাইসাইকেল চালায়। কিন্তু পথচারী দেখেলে পাশ কেটে যায়।
একদিন ২০-২২ বছরের এক মেয়ে ফুটপাত দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আমাদেরকে পাশ কাটতে গিয়ে সাইকেলসহ ফুটপাতের বাইরে পড়ে বেশ আঘাতপ্রাপ্ত হলো। আমাদেরকে ফুটপাত ছেড়ে দিতে গিয়ে সে বাইরে পড়লেও আমাদেরকে বিন্দুমাত্র অভিযোগ করলনা। বরং তার চেহারা দেখে মনে হলো সে উলটো অপরাধবোধ করছে।
ওরা ফুটপাত খুব পরিস্কার রাখে, শুধু কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া ফুটপাতে দোকান বসাতে পারেনা। তাছাড়া ধুলোবালিও তেমন নেই। চারপাশের পরিবেশ সুন্দর রাখা যে একটা নৈতিক দায়িত্ব, এই বোধটা যতদিন নিজের মাঝে তৈরি না হবে ততদিন আমাদের দেশ এদিক থেকে পিছিয়ে থাকবে।