মিজান সাহেবের ছোট্ট আদরের পূর্ণিমার দেহটা আজ বড্ড ভারী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ২৫ বছরের পূর্ণিমার ওজনটা নেওয়ার শক্তি যেন উনার নেই। উনি ভাবছেন, আসলে কী পূর্ণিমার ওজন নাকি পূর্ণিমার নিথর দেহ উঠানোর শক্তি উনার নেই! কী করে পারবেন তিনি তাঁর প্রিয় ভাগ্নির দেহটাকে মাটিতে রেখে আসতে? বড় বোনের মেয়ে হলেও সেই ছিলো তাদের সবার মেয়ে।
মিজান সাহেবের বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে পূর্ণিমার জন্মের সময়ের কথা। বুবুর বিয়ের ১০ বছর পর পূর্ণিমার আগমন। সেদিন ছিলো ভরা পূর্ণিমার রাত। সেই রাতের চাঁদটা অন্যান্য পূর্ণিমা রাতের চাঁদের চাইতে অনেক বড় আর উজ্জ্বল ছিলো। হাসপাতালে বোনের কাছে যাওয়ার সময় এত সুন্দর চাঁদ দেখে ভাবছিলো যদি বুবুর মেয়ে হয় তাহলে তার নাম রাখবো পূর্ণিমা।
মিজান হাসপাতালে ঢুকার সঙ্গে সঙ্গেই খবর পেল তাঁর বুবু একটা মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। কেবিনে ঢুকে দেখল তার বুবুর পাশে এক টুকরো চাঁদ শুয়ে আছে। যে চাঁদ একটু আগে আকাশে দেখে এসেছে মনে হলো সেই চাঁদটি মাটিতে নেমে এসেছে। সে বুবুর কাছে এসেই বলল আমি ওর নাম রাখব। তোমরা সেই নাম পছন্দ কর বা নাই কর, আমি সেই নামেই ডাকব। ওর নাম পূর্ণিমা।
কেবিনের সবাই সায় দিলো। বাচ্চার বাবা, মা, দাদা, দাদী, নানা, নানী সবার নামটা পছন্দ হলো। সকলেই বলল নামটা যথার্থ হয়েছে। এতো সুন্দর পূর্ণিমার রাতে যার জন্ম, দেখতে যে পূর্ণিমার চাঁদের মত, তার নাম পূর্ণিমা ছাড়া অন্য কিছু বেমানান।
পূর্ণিমা হেসে খেলে সবার মাঝে বড় হতে লাগলো। মিজানের বিয়ের বেশ ক’বছর পার হলেও তার ঘরে এখনো কোন নতুন অতিথি আসেনি। তারা অপেক্ষা করে আছে হয়ত বোনের মতো তাদেরকে একসময় আল্লাহ ঘর আলো করে দিবেন। দুই ভাই বোনের ঘরে একমাত্র সবে ধন নীলমনি পূর্ণিমাই সবকিছু। পূর্ণিমা তার নানা এবং দাদা বংশের একমাত্র বাতি। পূর্ণিমা বাবা হলো তার দাদা দাদীর একমাত্র সন্তান। এই মেয়েটি হলো দুই পরিবারের সবার নয়নের মণি।
পূর্ণিমা দিন দিন বড় হতে থাকে আর তার রূপের ঝিলিক যেন বাড়তে থাকে। চারপাশ থেকে বিয়ের প্রস্তাব, প্রেমের প্রস্তাব আসতেই থাকে। এইসব প্রস্তাবে সাঁয় না দিলে বিভিন্ন রকমের হুমকিও আসতে থাকে। এস এস সি পরীক্ষার সময় পরিবারকে অনেক সর্তক থাকতে হয়েছে। ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত পরিবারের কেউ বিয়ে দেওয়ার পক্ষেও ছিলেন না।
মিজান তার সকল কাজের মধ্যেও ভাগ্নিকে কলেজে দিয়ে আসত এবং নিয়ে আসত। অনেকেই জানত মিজান তার বাবা। এত জ্বালা যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবার জন্য এইচ এস সি পরীক্ষার পর পরই খুব ভালো একটা ছেলের সাথে পূর্ণিমার বিয়ে দেওয়া হলো।
পূর্ণিমার শ্বশুর বাড়ির লোক এবং তার স্বামী হিমেল সবাই খুব ভালো মানুষ। পূর্ণিমা আর হিমেল দুজন দুজনকে খুব ভালো বুঝতে পারে। ওদের খুব সুখের সংসার। তাদের বাসর রাতটা ছিলো ভরা পূর্ণিমার রাত। পূর্ণিমা হিমেলকে বলেছিলো যদি প্রতি পূর্ণিমা রাত এমন গল্প করে কাটানো যেত, তাহলে খুব মজা হতো।
হিমেল পূর্ণিমার বাসর রাতের সে কথাটা মনে রেখেছে। পূর্ণিমা যেন পূর্নিমার চাঁদ বিছানা শুয়ে দেখতে পারে এবং তাঁর বারান্দায় যেন চাঁদের আলো এসে পড়ে, এমন বাসা খুঁজতে তিন মাস লাগিয়েছে হিমেল।
প্রতি পূর্ণিমা রাতে তারা গল্প করে কিংবা গান শুনে কাটিয়ে দিত। আর প্রতি বছর একবার করে ভরা পূর্ণিমার রাতে দূরে কোথাও ঘুরতে যেত। এইভাবে করে তাদের সংসার জীবনের চতুর্থ বছরে ঘর আলো করে এলো তাদের পুত্র সন্তান। যেন মায়ের অবিকল। জন্মও হলো ভরা পূর্নিমা রাতে। এবারও মিজান সাহেব নাতির নাম রাখলেন শশী।
শশীর একবছর পূর্তি হওয়ার পরপর হিমেল ঠিক করলো তারা সাজেক ঘুরতে যাবে এবারের পূর্ণিমা রাতে। মাঝে একবছর পূর্ণিমার প্রেগন্যান্সির জন্য যেতে পারেনি। এবার তাদের ছেলেসহ যাবে। নির্ধারিত দিনে তারা রওয়ানা দিলো। ভরা পূর্ণিমা রাতে সাজকের সৌন্দর্যে পূর্ণিমা বিমোহিত। এত সুন্দর পূর্ণিমা রাত তাঁর ২৫ বছর জীবনে কখনো দেখেনি।
পূর্ণিমা সাজেকের রিসোর্টের বাহিরের শুয়ে শুয়ে ভাবছে, আমি খুব ভাগ্যবতী। এই ২৫ বছর জীবনে দুঃখ কী জিনিস আমি দেখিনি। সুখ আমার জীবনে কানায় কানায় ভর্তি। এই জীবনে আমার কোন অপূর্ণতা নেই। আমার জীবনের শেষদিন যেন এমন ভরা পূর্ণিমা হয়। এমন সময় শশীর কান্নায় পূর্ণিমা উঠে ঘরে গেল শশীকে শান্ত করতে।
দুদিনের সফর শেষে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। একটা ভাড়া মাইক্রো নিয়ে তারা রওয়ানা দিয়েছিলো। ঢাকা-চট্রগ্রাম রোডে হঠাৎ করে একটা লরীর সাথে ধাক্কা। প্রচন্ড শব্দ। কারোর আর কিছু মনে নেই।
পুলিশ স্টেশন থেকে ফোন পেয়ে মিজান দৌঁড়ে হাসপাতালে আসে। জানত পারে এক শিশুসহ তিনজন স্পট ডেথ এবং দুইজনের অবস্থা আশংকাজনক যাদের মধ্যে একজন মহিলা। মিজানের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তার বুঝতে বাকী রইল না। লাশ শণাক্তকরণের পর জানা গেল হিমেল, শশী আর ড্রাইভার বেঁচে নেই। গাড়ির সহকারী আর পূর্ণিমার অবস্থা আশংকাজনক।
গাড়ির সহকারী দুদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে মারা গিয়েছেন। আজ ২৫ দিন হলো পূর্ণিমা কোমায় আছে। পূর্ণিমার বাবা, মা, শ্বশুড়, শাশুড়ী, মামা সবাই দিন রাত পালা করে হাসপাতালে একটা সুখবরের আশায় দিন পার করে যাচ্ছে।
আজ রাত যখন মিজান হাসপাতালে দিকে আসছিলেন তখন ২৫ বছর আগের এই দিনটির কথা মনে পড়ে গেল। এমনি এক ভরা পূর্ণিমা রাতে আমাদের সকলের মনে আশার আলো নিয়ে এসেছিলো পূর্ণিমা। চাঁদের দিকে তাকাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে। শেষ যখন পূর্ণিমার সাথে কথা হয় সেদিনও ভরা পূর্ণিমার রাত। মামার সাথে তার সব কথা শেয়ার না করলে মনে শান্তি পেত না। সাজেকে এসে ভরা পূর্ণিমায় তার অনুভূতির কথাগুলো জানিয়েছিল মামাকে। শশীকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ফোনে কথাগুলো মামাকে বলছিল। এটাই ছিলো তাদের শেষ কথা যেখানে শেষ ইচ্ছেটাও প্রকাশ করেছিল।
কখন হাসপাতালে পৌঁছে গেছেন তাঁর মনে নেই। হাসপাতালে সবার শোরগোলে উনার চেতনা ফিরে এলো। জানতে পারলো পূর্ণিমা অবস্থা খুব খারাপ করেছে, তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে হবে। লাইফসাপোর্টে দেওয়ার আগেই সব শেষ করে পূর্ণিমা সব আঁধার করে চলে গেল।
পূর্ণিমাকে শেষ ঠিকানায় রেখে এসে বিমর্ষ চিত্তে বসে আছেন। ভাবছেন মেয়েটার শেষ ইচ্ছেটাও আল্লাহ পূরণ করছেন। হয়ত এমন মৃত্যু কামনা করেনি কিন্তু এমন সময় চেয়েছিল। পূর্ণিমার মৃত্যু পূর্ণিমা রাতে। মিজান সাহেবের স্ত্রী নীলা পাশে এসে বসলেন। বললেন তুমি মন খারাপ করো না। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে নিরাশ করেন না। তিনি তোমাকে নিশ্চয়ই পূর্ণিমা বা শশী দিবেন।
মিজান বুঝতে পারছেন না তাঁর স্ত্রী কী বলতে চাচ্ছেন। বললো কিভাবে? তখন নীলা বলল, গত একমাস যাবত আমি তোমাকে কিছু জানাইনি, কারণ তোমার মনের অবস্থা খুব খারাপ ছিলো। আমি নিজে নিজেই সব ডাক্তারের কাছে দৌঁড়াদৌঁড়ি করেছি। দুদিন হলো রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। ১৮ বছর পর আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। তুমি বাবা হতে চলছ। মিজান নীলাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল। প্রার্থনা করল আর কোন পূর্ণিমার রাত যেন আমাদের জীবনে নিকষ কালো আঁধার হয়ে না আসে।