কিছু ভিন্নতা, কিছু নিয়ম, কিছু অসংগতি
আমেরিকা বিশ্ব দরবারে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সেরা বলে দাবি করে। আমার দেখা কিছু অসংগতির কারণে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের দেশের নিয়মের কারণে আমার দেশকেই গণতন্ত্রের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ মনে হয়। ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটিতে ‘কান্ট্রি প্রেজেন্টটেশন’ নামে একটা প্রোগ্রাম ছিলো। যেখানে প্রত্যেকে নিজের দেশের উপর প্রেজেন্টটেশন দিতে হয়েছে। সেই বছর কোর্সে ৩৫টি দেশের প্রতিনিধি ছিল। আমারও সুযোগ হয়েছিলো নিজের দেশকে তুলে ধরার। দেশকে তুলে ধরার এই সুযোগে যতটুকু পেরেছি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
আমি আমার প্রেজেন্টটেশনের একটা অংশে বলেছিলাম যদিও আমরা মুসলিম অধ্যুষিত দেশ তবে আমার দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। এখানে ৯১.৪% মুসলিম, ৭.৯৫% হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী .৬% এবং খ্রিষ্টধর্ম পালনকারী .৪% । যে যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতে পারে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সব ধর্মাবলম্বীদের জন্য ধর্মীয় উৎসব পালনের জন্য জাতীয়ভাবে ছুটি দেওয়া হয় এবং আমরা সব ধর্মের লোক সব ধর্মের ছুটি উপভোগ করি। আমাদের ধর্মীয় উৎসব পালনের এই রীতি শুনে সবাই খুব অবাক হয়েছিল।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে আমেরিকায় মুসলিমদের অবস্থান তৃতীয়। অথচ সেখানে মুসলিমরা কোন সরকারী ধর্মীয় ছুটি পায়না। তাদের জন্য আলাদা করে নেই কোন ধর্মীয় উৎসবের ছুটি। শুধু খ্রীষ্টানদের সকল ধর্মীয় উৎসবে জাতীয় ছুটি। আর অন্য কোন ধর্মের জন্য কোন ছুটি নেই।
ইউএসএ এর ব্যবসায়িক ব্যবস্থাটা একটু অন্যরকম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যার যেমন ইচ্ছা তেমন দাম রাখে। কোথাও ডিমের ডজন ৪ ডলার, আবার কোথাও ১-২ ডলারেও পাওয়া যায়। দেখা যায় রাস্তার দুই ধারে বা পাশাপাশি দুইটা গ্যাস স্টেশন, মানে গাড়ীর জ্বালানী তেলের ফিলিং স্টেশন। কিন্তু তেলের মূল্য গ্যালনে ২০-৩০ সেন্ট পার্থক্য। শুধু গ্যাস নয় সব কিছুই এমন। একটা লিপিষ্টিক থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রেই দামের তারতম্য।
আমাদের যেমন সারা দেশে এক রেট তাদের তেমন কোম্পানী রেট বলে কিছু দেখলাম না। তবে তাদের সরকার নির্ধারিত মূল্য না থাকলেও কেউ সেগুলো নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। বরং নিজের চাহিদামতো দামে কোথায় কোন পণ্য পাওয়া যায় তার খোঁজ করে।
সীমিত আয়ের মানুষদের আমেরিকায় অনেক হিসেব করে চলতে হয়। কোথায় কোন জিনিস কম দামে পাওয়া যায় সেই খোঁজ সবসময় রাখতে হয়। যার কিছু চিত্র পাবেন আমার ব্ল্যাক ফ্রাইডে লেখাতে। সাধারণ মানুষ সেল ছাড়া তেমন একটা কেনাকাটা করে না। আর সেল মানে কিন্তু বেশ ভালো সেল। সেলের সময় মূল মূল্য বাড়িয়ে তারপর সেল রেট দেয় এমনটা নয়। রেগুলার দামের উপর অনেক ছাড় দিয়ে থাকে। যদিও ওদের রেগুলার দামও অনেক বেশি।
বিভিন্ন শপে প্রথম প্রথম আমরা দেখতাম অনেকে কুপন নিয়ে কেনাকাটা করে। এই কুপনগুলো দিলে অনেক ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। প্রথমে আমরা জানতাম না কোথায় থেকে এই কুপনগুলো কালেক্ট করতে হয়। পরে জানতে পারলাম ইমেইল, সানডে পেপার এগুলোতে এই কু্পনগুলো পাওয়া যায়। আমরাও মহা আনন্দে কুপন জোগাড় করতে লাগলাম এবং তা দিয়ে কেনাকাটা করতাম। আমরা ব্যাপারটা খুব উপভোগ করতাম। মাঝে মাঝে মনে হতো ছেলে মানুষী করছি তবুও মজা পেতাম। অনেক সময় দেখা যেত একটা জিনিস কিনতে যেয়ে রিবেট এবং কুপন দিয়ে জিনিসটাই ফ্রি হয়ে যেত।
কুপন বেশি নিয়ে আসত বয়স্করা। ওরা খাবার বেশি কিনেই খায়। রান্নার ঝামেলায় যেতে চায় না। একবার দেখি একজন বয়স্ক মহিলা ১৩৫ ডলারের কেনাকাটা করল। এবার বিল পরিশোধের সময় তার সব সংগৃহীত কুপন বের করতে লাগল। হিসেব করে দেখা গেল তিনি ৮৫ ডলারের কুপন জমা দিয়েছেন আর তাকে নগদ দিতে হলো ৫০ ডলার!
আমেরিকার আরেকটা ব্যবসায়িক ব্যবস্থা হলো ফেরত নেওয়া। আমার ধারণা এই ফেরত নেওয়ার সিস্টেমের জন্যই সব কিছুর এত দাম। একটা জিনিস কিনে আপনি নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে ফেরত দিতে পারবেন। অনেকের কাছে শুনেছি কেউ কেউ শার্ট কিনে, ড্রেস কিনে পার্টিতে পড়ে আবার ফেরত দিয়ে যায়। ফেরত দেওয়ার এমন একটা সত্যি ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। তিনি কোন দেশী ছিলেন তা প্রকাশ করছি না। সেই ভদ্রলোক একজোড়া জুতা কিনেছিলেন যার ফেরত দেওয়ার মেয়াদ ছিলো একবছর। ঐ ব্যক্তি মেয়াদের শেষদিন দোকান বন্ধ হওয়ার ১ ঘণ্টা আগে এসে তার পা থেকে জুতা খুলে ফেরত দিয়েছে! দোকান ও ফেরত নিয়েছে কারণ তিনি কেনার স্লিপটা যত্ন সহকারে রেখে দিয়েছিলেন। আমি যখন ছিলাম তখন দেখেছি ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে পণ্যের প্রাইস ট্যাগ থাকতে হবে। এর আগে নাকি শুধু কেনার স্লিপ দেখালেই হতো।
কয়েকটা দোকানে শার্ট কিনতে গিয়ে দেখেছি শার্টটা খুলে পড়ে ট্রায়াল দিয়ে কুচকিয়ে রেখে চলে যায়। মানুষের এমন অশোভন আচরণ দেখে আমি খুবই হতবাক হতাম। পরে দেখতাম ঐ শার্টটা সেলে চলে যায়। ঐ দেশে ভোক্তার অধিকার আগে।
আমাদের শপগুলোতে বিভিন্ন সেকশনে জিনিস দেখানোর জন্য লোক থাকে, ওখানে বড় বড় শপগুলোতে কসমেটিকস সেকশন ছাড়া আমি অন্য কোন সেকশনে তেমন বিক্রয় প্রতিনিধি দেখিনি।
মানসম্মত খাবার পরিবেশন না করলে আপনাকে মামলার মুখোমুখি হতে হবে। আপনি কোন রেস্টুরেন্টে খাবারের মধ্যে যদি চুল পান তাহলে সেটা অভিযোগ করলে খাবারটার জন্য কোন বিল দিতে হয় না বরং নতুন করে আবার খাবার দেওয়া হয়। আপনি চাইলে সেই রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশনের জন্য মামলাও করতে পারেন। অনেকে ইচ্ছে করে খাবারের শেষ পর্যায়ে চুল ফেলে দাবি করত যে চুলটা রেষ্টুরেন্টের খাবারের সাথেই ছিলো। মালিকপক্ষ বুঝেও মামলা এড়ানোর ভয়ে মিথ্যে অভিযোগ মেনে নিত। খাবারটার জন্য কোন বিল পরিশোধ করতে হতো না অথবা আরেকটা নতুন খাবার দেওয়া হতো।
রেস্টুরেন্টের সামনের জায়গা অপরিচ্ছন্ন রাখলে আপনার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। শুধু রেস্টুরেন্ট কেন আপনার বাড়ির আশপাশের জায়গায় আপনি অপরিস্কার রাখতে পারবেন না। কেউ কেউ রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করে সযত্নে পানি বা তেল জাতীয় কিছু ফেলে হাঙ্গামা শুরু করে দেয়। আসল উদ্দেশ্য রেস্টুরেন্ট মালিক থেকে কিছু আদায় করা। মালিক পক্ষ ঝামেলা এড়াতে অধিকাংশ সময় তা মেনে নেয়। এখানে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকাটা আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। এর জন্য আপনাকে পে করতে হয়। আসলে এভাবেই একটা জাতিকে সঠিক পথে আনতে হয়।
আমেরিকাতেও অনেক গৃহহীন মানুষ আছে। ওদের এখনও এমন এলাকা আছে যেখানে বিদ্যুৎ এর আলো পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ওদের ভিক্ষুক আছে তবে আমাদের মত নয়। ওদের ভিক্ষুকরা রেলস্টেশন, মার্কেটের সামনে, রাস্তার মোড়ে সাইনবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ গান বাজিয়ে শোনায়, কেউবা বাদ্যযন্ত্র বাজায়। তাদের পোশাক একটু উন্নতমানের এটাই পার্থক্য।
আমেরিকাতে গৃহহীনদের জন্য সরকারীভাবে থাকার ব্যবস্থা থাকলেও অনেকে সেখানে থাকতে চায় না। কারণ ওখানে থাকলে নাকি অনেকের মাদকের টাকা জোগাড় হয় না। তারচেয়ে গৃহহীন হয়ে বাহিরে থেকে হাত পেতে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে তাদের নেশার টাকা যোগাড় হয়ে যায়। এগুলো কোনটাই আমার নিজের কথা নয়, সবকিছুই জেনেছি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে।
ওদের এখানে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া একটা ঘুমের ওষুধ, এন্টিবায়োটিক, ব্যথা নাশক কোন ওষুধ কেনা যায় না। আর আমাদের দেশে আমরা ঘরে ঘরে ডাক্তার। নিজের ইচ্ছেমত ওষুধ কিনতে না পারলেও আমেরিকায় বৈধ অস্ত্র কেনার অবাধ সুযোগ পাচ্ছেন। ঘরে ঘরে বৈধ অস্ত্র আর তা দিয়ে প্রকাশ্যে ঘটাচ্ছে হত্যাকান্ড। বৈধ অস্ত্র রাখা তাদের নাগরিক স্বাধীনতা।
বিশাল বড় এই দেশটাতে খুন, ঘুম, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণের হারও প্রচুর। বছরের পর বছর অপহরণের ঘটনার কোন কুল কিনারা পায় না। হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে পারে না। এমন অনেক অসামঞ্জস্য রয়েছে। যা রয়ে যায় লোক চক্ষুর অন্তরালে।