ফিরে দেখা সাড়ে এগারো মাস- কত রকমের অভিজ্ঞতা সঞ্চার হলো প্লেনে বসে তাই ভাবতে লাগলাম। দীর্ঘ পথ যাত্রায় এগারো মাসের অভিজ্ঞতাগুলো একে একে ভেসে উঠল। থ্রি ডব্লিউ নিয়ে আমেরিকায় প্রচলিত একটা বাক্য আছে। তারা বলে তাদের এখানে থ্রি ডব্লিউ এর উপর কোন বিশ্বাস নেই- ডব্লিউ ফর ওয়েদার, ডব্লিউ ফর ওয়াইফ, ডব্লিউ ফর ওয়ার্ক।
সেই অবিশ্বাস্য একটা ডব্লিউ মানে আবহাওয়ার রূপ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। রেকর্ড সৃষ্টিকারী বরফ পড়া দেখেছি, প্রচন্ড গরম ও সাথে লু হাওয়া বইতে দেখেছি। এই শীত, এই বৃষ্টি, প্রচুর রোদ অথচ ঠান্ডায় অস্থির হওয়া এই রকম মিশানো আবহাওয়া দেখেছি। যার কিছু বর্ণনা আমার ডিজনি পর্বে রয়েছে। আবহাওয়া নিয়ে আমরা কয়েকবার হোঁচট খেয়েছি।
আমার স্বল্পকালীন বসবাসের সময় খুব বেশী বাঙ্গালিদের সান্নিধ্য না পেলেও যতটুকু জেনেছি তাদের মাধ্যমে মোটামুটি ধারণা পেয়েছি আমাদের বাঙ্গালীরা কেমন আছে প্রবাসে। প্রবাসে বাঙ্গালীদের আন্তরিকতা অতুলনীয়। কিছু ব্যতিক্রম আছে যা সব ক্ষেত্রেই থাকে। প্রথম প্রথম কোন মলে বা শপে বাঙ্গালী কাউকে দেখলেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তাম। এগিয়ে গিয়ে অনেকের সাথে কথা বলতাম। কেউ কেউ আন্তরিকতা দেখাত, কেউ আবার তেমন প্রতিক্রিয়া বা আগ্রহ দেখাত না।
আমার জানামতে প্রবাসে বিভিন্ন শ্রেনীর বাঙ্গালী আছে। এই শ্রেণী বিভাজন তাদের নিজেদের অজান্তেই হয়েছে। যেটা হয়ত তারা নিজেরাও জানেন না। আমেরিকায় উচ্চাসনে অনেক বাঙ্গালী রয়েছেন। মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছেন এমন বাঙ্গালীর সংখ্যাটা বেশি। আবার অনেকে রয়েছেন কোন রকমে টিকে আছেন। ফেরার কোন উপায় নেই। কাগজ পত্র ঠিক নেই। একবার ফিরলে আর ঢুকতে পারবে না। তাই কোন রকমে দিন পার করে দিচ্ছে আর যা উপার্জন করছে তা দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশিরভাগ প্রবাসীর বিরূপ মনোভাব, বিরক্তিভাব। যারা ১৫-২০ বছর বা তার চাইতে বেশি প্রবাসজীবন যাপন করছে তাদের দেশপ্রীতি খুব গভীর। অনেকেই বাচ্চাদের পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরতে আগ্রহী। কিন্তু যাদের ৫-১০ বছর প্রবাস জীবন হয়েছে তাদের দেশের প্রতি বিরূপ মনোভাব বেশী।
অনেকের কথা শুনলে মনে হবে তারা আজন্ম আমেরিকান! বাংলাদেশে যারা থাকে ওরা মনে হয় ভিনগ্রহের মানুষ। এত জ্যাম, নিরাপত্তাহীনতা, বিদ্যুৎ সমস্যা, পানি সমস্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি সবকিছু নিয়ে যারা আছে তারা মানুষ নয়, তার উর্দ্ধে কিছু! আমরা যারা দেশে আছি তাদের জন্য উনাদের খুব মায়া হয়।
আমাকে প্রায়ই দুটো প্রশ্নের উত্তর দিতে হতোঃ ১। আমি ফেরত আসছি বলে আমার খারাপ লাগছে কিনা? ২। যেহেতু ৫ বছরের ভিসা আছে তাহলে আমি কেন থেকে যাচ্ছি না কিংবা আবার ফিরে আসছি কিনা?
আমার উত্তর একটাই ছিল- আমার মোটেও খারাপ লাগছে না। কারণ আমরা আসার সময় জেনে এসেছি আমেরিকাতে আমরা একবছরের জন্য অতিথি হয়ে এসেছি। যদিও আমাদের ভিসা ৫ বছরের ছিল। তারপরও আমাদের একবারের জন্যও থেকে যেতে ইচ্ছে হয়নি কিংবা মনে কোন আফসোসও হয়নি। আমার উত্তর শুনে অনেকে আশাহত হয়েছে।
আমার সবসময়ই মনে হতো আমি কখনই এদেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হতে পারব না। দেশে আমার হাজারো সমস্যা হলেও আমি আমার দেশের একজন প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। সেটা আমার নিজের দেশ। আমেরিকায় যত আরামেই থাকি না কেন সেখানে আমার নিজের বলে কিছু অনুভব করতে পারতাম না। আমার নিজের দেশে একটা ‘আমি আমি’ ভাব বা নিজস্বতা আছে যেটা আমি কখনই আমেরিকাতে পাইনি।
আমাদের সাথে যারা বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন উনাদের অনেকের স্ত্রী আর বাচ্চারা রয়ে গেছেন। অনেকেই বলেছিল ছেলে মেয়েদের জন্য কেন আবেদন করে যাচ্ছি না? শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের ভালো পড়া লেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ওদের বাবাকে দেশে একা রেখে আমরা তিনজন আমেরিকায় থাকার পক্ষে আমি ছিলাম না। আমি মনে করতাম ওদের যোগ্যতা থাকলে ওরা নিজেরাই একদিন আসার সুযোগ পাবে। আল্লাহ অশেষ রহমতে তারা তাদের যোগ্যতায় স্কলারশীপ নিয়ে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
আমাদের দেশ থেকে পড়ালেখা করে অনেক জ্ঞানী-গুনী লোক বিশ্ব দরবারে স্থান পেয়েছে। যেমন বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি এফ আর খান, উনি আমাদের বুয়েট থেকে পড়ালেখা করেছেন। নোবেল বিজয়ী ড: মোহাম্মদ ইউনুস, আমাদের চট্রগাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছেন। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে।
একটা কথা সত্যি আমাদের দেশে গুণীর কদর হয় না। যদি ঠিক মত গুণীরা কদর পেত তাহলে নিজের মেধাকে অন্য দেশের জন্য না খাটিয়ে আমাদের নিজেদের জন্য কাজে লাগাত। সেরকম হলে এতদিনে আমরাও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এইভাবেই গুণী, মেধাবীদেরকে মূল্যায়ন করে অন্য দেশের অমূল্য সম্পদ এই মেধাবীদেরকে নিজেদের কাজে লাগিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। এই নির্দিষ্ট জায়গাটাতে পরিবর্তনটা আনতে পারলে আমাদের এগিয়ে যাওয়াটা অনেক সুগম হবে।