আমার দৃষ্টিতে স্বপ্নের দেশ ৩১। আমাদের সীমাবদ্ধতা

আমেরিকায় অনেক উন্নত নাগরিক সুবিধা, ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা এইসব নিয়ে আমার কোন দ্বিমত নেই। আমি অবশ্যই এই ব্যাপারগুলো উপভোগ করেছি। আমি আশা করি আমাদের দেশও একদিন এই সকল সুবিধায় সমৃদ্ধ হবে। আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতিটা দ্রুত ঘটাতে পারলে বাংলাদেশ একদিন উন্নত দেশের কাতারে পড়বে। তখন এত গণহারে বিদেশে পড়তে যাওয়া কমে যাবে। শিক্ষা ব্যবস্থাতে বিপ্লব ঘটাতে পারলে আমাদের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী।

আমেরিকা নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য অনেক কিছুতে নিজেদের মত করে নিয়েছে। ওরা গাড়ির তেলকে বলে গ্যাস, অনেক শব্দের ব্যবহার বা উচ্চারণ ভিন্ন, ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই ১১০ ভোল্ট, গাড়ির স্টিয়ারিং বাম দিকে। এই রকম অনেক কিছু আছে যাতে তারা প্রমাণ করতে চায় তারা অন্যদের চাইতে ভিন্ন। তবে একটা কথা সত্যি, তাদের দেশপ্রেম অনেকগুণ বেশি। ওদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা এসেছে তারা তাদের দেশকে সত্যি ভালোবেসেছে বলেই ২০০ বছরে তারা আজ পৃথিবীর নাম্বার ওয়ান দেশ হিসাবে নিজেকে জাহির করতে পারছে। বলতে গেলে তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বটাকে। যদিও তাদের নৈতিকতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। 

আমার ব্যক্তিগত অভিমত কারোর যদি জীবন চলার মত জীবিকা থাকে এবং সঙ্গে কিছু জমানোর মত ক্ষমতা থাকে তার দেশ ছেড়ে যাওয়া উচিত না।

আমরা সন্ধ্যায় বাহরাইন বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালাম। বিমান বন্দরে মনে হলো বাঙ্গালীদের সমাবেশ। অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশী। বাহরাইন আমাদের শেষ ট্রানজিট। রাতে বাহরাইন থেকে রওয়ানা দিলাম আমাদের নীড়ের ঠিকানায়। ২৬শে জুন’ ২০১০ সময় সকাল সাড়ে ছয়টা, আমার সোনার দেশের সীমানায় ঢুকে পড়েছি। আসার সময় প্লেনের উপর থেকে কয়েকটা দেশ দেখেছি সেগুলোর সাথে আকাশ থেকে দেখা ঢাকার চিত্র দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। আগুছানো শহর, কেমন যেন এলোমেলো। বারবার মনে মনে আল্লাহ তায়লার কাছে প্রার্থনা করেছি যেন আমার দেশের সকল সমস্যার দ্রুত সমাধান করে দেন। 

এত অসুন্দরের মাঝেও মনে খুব তৃপ্তি, প্রশান্তি আর আনন্দ, নিজের দেশে এসেছি। এখানে আমার প্রাণ, এখানে আমার সব আপনজন, এখানে আমার সবকিছুই নিজের। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তেমন কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। যতটুকু আছে তা দিয়ে নিজেদের চলাই দায়। প্রাকৃতিক সম্পদ যেটুকু আছে তা উত্তোলনের টাকাও নেই আমাদের। না আছে আমাদের বিশাল ভূমি। আছে শুধু মানব সম্পদ আর আছে খাঁটি মাটি। যেখানে যা ফলাতে চাই তাই ফলে। কিন্তু সেই মাটিও সীমিত। ঘন বসতি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, অর্থের  অভাবে আমরা সেটাকেও কাজে লাগাতে পারিনা । একজনের উপর পাঁচজনের সংসার চলে। ছেলে মেয়েদের দায়িত্ব ১৮ হলেও আমরা তাদের ছেড়ে দেই না। একেবারে পড়া শোনা শেষ করিয়ে, কর্মসংস্থানে ঢুকিয়ে, সংসার করানো পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পিতা মাতার উপর।

আমাদের কত উৎসব ইদ, পূজা, বড়দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, নববর্ষ, নবান্ন আরো কত কি। সামান্য কোন কারণ পেলেই আমরা তা উদযাপন করি। সব শত অভাবের মাঝেও আমরা সবাই মিলে  তা আনন্দ চিত্তে পালন করি। সব ধর্মের উৎসব আমরা সবাই উপভোগ করি।

যত বড় দেশ তত বেশি অঘটন। আমেরিকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, গুম, সড়ক দূর্ঘটনা, অপহরণ, ধর্ষন, চুরি, ভোট চুরি, প্রতারণা, জুয়া সবই ঘটে। কিন্তু কার খবর কে রাখে। অবিশ্বাস্যভাবে এইসবের সংখ্যাটাও নিতান্ত কম নয়। আমরা জাতিগতভাবেই অন্যের বিষয়ে বেশি নাক গলিয়ে থাকি। জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ সব ব্যাপারে আলোচনা সমালোচনা করার অফুরন্ত সময় থাকে আমাদের হাতে। বর্হিবিশ্বে আমাদের স্থান তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই তাইতো আমাদের সব কিছুতেই সবার মাথাব্যথা।

বিশাল জনগোষ্টীর জন্য আমাদের সীমানা অপ্রতুল। চাহিদামত খাদ্য উৎপাদন করার জমিটুকু পর্যন্ত আমাদের নেই। আবার আমাদের খাদ্য অভ্যাসটাও রাজকীয়! কত রকমের মসলা লাগে আমাদের রান্নায়। যার বেশিরভাগ মসলার যোগান দিতে হয় আমদানীর মাধ্যমে। কত পদের মাছ, কত পদের শাক-সবজি, কত পদের মাংস, বিভিন্ন রকমের মিষ্টি এমন তালিকা করলে দেখা যাবে আমাদের খাদ্যের তালিকা বিশাল সমাহার।

আমাদের খাদ্য অভ্যাসের কারণে রান্নাঘরে আমাদের দেশের মেয়েদের জীবনের অর্ধেকের বেশী সময় কেটে যায়। তিনবেলা ভারী খাবারের সাথে হালকা নাস্তা পানির জন্য আরোও দুইবেলা! অথচ উন্নত দেশগুলোর জীবন যাত্রা দেখলে বুঝবেন এই রান্না বা খাওয়ার পিছনে তাদের সময় বরাদ্ধ খুব অল্প। আমাদের  খাবারের এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরাও বদ্ধপরিকর! তবে মুরগীটা ছুরির চাইতে বটি দিয়ে কাটতেই বেশী সহজ!

Leave a Comment