আমেরিকার চিকিৎসা সেবা
বাংলাদেশ আর্মিতে কমান্ডো কোর্স (১৯৯৪ সালে) করার সময়আমার বর জাম্প দিতে গিয়ে কোমরে ব্যাথা পান। কমান্ডো কোর্স চলাকালীন উনার ডান হাতটাও উল্টে গিয়েছিল। সেই ভাঙ্গা হাত নিয়েই উনি কোর্স সম্পন্ন করেছিলেন।
কোরিয়াতে সীল কোর্স (১৯৯৭) করতে গিয়ে ডান পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল। আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পর দুই দেশের একটা অনুশীলন চলার সময় উনার বাম পা ভেঙ্গে ছিল। উল্লেখ্য বাকী যে বাম হাত, তা ছোট বেলায় ভেঙ্গে ছিল!
উনার সেই কোমর ব্যাথা মাঝে মাঝেই জানান দেয়। হয়ত কমান্ডো কোর্সের স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই তার আগমন। আমেরিকায় থাকাকালীন একদিন উনার প্রচন্ড কোমর ব্যাথা উঠে। উনি ইউনিভার্সিটির ডাক্তারকে দেখালেন। যেহেতু ডান পাশে ব্যাথা ছিলো তাই ডাক্তার দেখে বলল মনে হয় গলব্লাডার স্টোনের ব্যাথা। তুমি ইমার্জেন্সিতে দেখাও। ইমার্জেন্সি মানে হলো মিলিটারীদের জন্য নির্ধারিত একটা হাসপাতালের ইমার্জেন্সি। যেটা ইউনিভার্সিটি থেকে একটু দূরে অবস্থিত।
এই দেশে আসার আগে আমি ড্রাইভিং শিখেছিলাম এবং ইন্টারন্যাশনাল লাইসেন্স নিয়ে এসেছিলাম। মাঝে মাঝে কয়েকদিন আসে পাশে চালিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করছিলাম। একদিন রাত ১১ টার সময় আমি ড্রাইভ করছিলাম। আমার সাথী পাশেই ছিলেন। উনি পাশে বসে আমাকে ডান বামের নির্দেশনা দিয়ে ড্রাইভিং এ পারদর্শী করতে তুলতে সহায়তা করছিলেন। কিন্তু আমার যে ডান-বামের একটা সমস্যা আছে আমি নিজেও তা ভুলে যাই। সেদিনও তেমনটা ঘটেছিল।
আমার কর্তা আমাকে গাড়ি বামদিকে মোড় নিতে বললেন, আমি যথারীতি ডান-বামের গন্ডগোল করে তাল গোল পাকিয়ে ফেললাম। বাম দিকের বদলে ডান দিকে গাড়ি ঘুরাচ্ছি ঠিক তখন বিপরীত দিক থেকে দ্রুত গতিতে একটা গাড়ি আসছিল। আমার কান্ড কারখানা দেখে অনেক জোরে জোরে হর্ণ দিচ্ছিল। তাড়াতাড়ি সঠিক দিকে সরে আসলাম। বিপরীত দিকের গাড়ির চালক আমার দিকে চোখ কড়মড় করে তাকিয়ে ইঙ্গিত করে বোঝাতে চাইল ‘আমি ড্রাঙ্ক’! ভাগ্যিস সেই সময় ওই রাস্তায় গাড়ি কম ছিল। তা না হলে মারাত্নক একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত।
সেই রাতের ঘটনায় আমি খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। ওই ঘটনার পর থেকে আমি আর গাড়ি চালাইনি। তেমন প্রয়োজনও পড়েনি। আমার কর্তাই সবসময় চালাতেন। তাছাড়া আমাদের বাসার সাথেই মেট্রো থাকায় যাতায়তের কোন অসুবিধা হতো না।
ইউনিভার্সিটি থেকে ২টার দিকে ফিরে বাচ্চাদেরকে বাসায় রেখে আমরা মিলিটারীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল Walter Reed Army Medical Center এ রওয়ানা দিলাম। বাসা থেকে ১ ঘণ্টা ড্রাইভ। প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে তিনিই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। যেহেতু তিনি ড্রাইভ করবেন এবং অসুস্থ তাই আমি তাকে একা যেতে দিলাম না।
হাসপাতালে পৌঁছতে বিকেল ৪টা বেজে গেল। অজানা আশঙ্কায় অস্থির লাগছিলো। পৌঁছে ওদের নির্ধারিত ফরম ফিলআপ করার পর ডাক্তার দেখাতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লেগে গেল। ব্লাড, ইউরিন টেস্ট করতে দিয়ে চলে গেল।
এরই মধ্যে ডিউটি শিফট হয়ে ডাক্তারের বদলী হলো। সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেল, কারোর কোন খবর নাই। আরো এক ঘণ্টা পর অন্য আরেকজন ডাক্তার এসে জানাল, না খারাপ কিছু না, মাসল পুল হয়েছে। আল্লাহর কাছে অসংখ্য শোকরিয়া আদায় করলাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় বারোটা।
ওদের ইমার্জেন্সি আমাদের মত নয়। ইমার্জেন্সিও চলে নিয়ম অনুযায়ী। অথচ আমাদের দেশে যদি ইমার্জেন্সিতে গিয়ে ফর্ম ফিলআপ করার এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর ডাক্তার আসে তবে ঐ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগের যে কি অবস্থা হবে তা মনে হয় সবাই অনুমান করতে পারছি। বিশাল পার্থক্য চোখে পড়ল চিকিৎসার এই জায়গায়।
ইউএসএ তে আপনি চাইলেই ফার্মেসী থেকে যেকোন ওষুধ বিশেষ করে ব্যাথানাশক, এন্টিবায়োটিক, কিংবা ঘুমের ওষুধ কিনতে পারবেন না। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেবল ভিটামিন, সাপ্লিম্যান্ট এবং হালকা ব্যাথানাশক ওষুধ কিনতে পারবেন। আর আমাদের দেশেতো ঘরে ঘরে আমরা সবাই ডাক্তার!
বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানোর সময় ভ্যাকসিন দিতে গিয়ে একটা রিপোর্টে আমার ছেলের টিবি ধরা পড়ল। ওরা এরপর এক্স-রে করতে আরেকটা সেন্টারে পাঠাল। এক্স-রে রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তবুও ওরা বলল, তোমাদেরকে আমরা চিকিৎসা দিয়ে দিচ্ছি। ৯ মাসের কোর্স। প্রতি মাসে ওরা ঔষুধ দিয়ে দিবে। ওদের সেন্টার থেকে নিয়ে যেতে হবে। তারপর ওরা বলল এখন একটা টিবির নতুন পরীক্ষা এসেছে। ওটাতে একদম নির্ভুল ফলাফল পাওয়া যায়। ব্যয়বহুল পরীক্ষা। আমরা চাইলে ঐ পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারি।
আমাদের হেলথ ইন্সুরেন্স করানো ছিল। তাই ভাবলাম পরীক্ষাটা করিয়ে নেই। ঐ পরীক্ষা যেখানে করানো হয় তার সিরিয়াল পেতে পেতে ১ মাস লেগে গেল। নির্ধারিত দিনে গেলাম হাসপাতালে। একগাদা ফরম ধরিয়ে দিল। পুরো বংশের কার কি রোগ আছে-কি নেই তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে হলো। এরপর একজন ডাক্তার দেখল তারপর পরীক্ষা করতে পাঠাল।
পরদিন ফোনে জেনে নিলাম পরীক্ষা ফলাফল নেগেটিভ। ওরা বলল টিবি সেন্টারে রিপোর্টটা পাঠিয়ে দিবে আর আমাদের ঠিকানায়ও রিপোর্টটা চলে আসবে। কয়েকদিন পর টিবি সেন্টার থেকে ফোন আসল দ্বিতীয় মাসের ঔষুধ নিয়ে আসার জন্য। আমরা বললাম টিবির রিপোর্টতো নেগেটিভ এসেছে এবং ডাক্তার বলেছে তার আর ঔষুধ খেতে লাগবে না। আপনাদের কাছেও রিপোর্টের কপি যাওয়ার কথা। তারা বলল কোন কারণে তারা সেই রিপোর্ট পায়নি। পরেরদিন আমাদের রিপোর্টের কপি দেখার পর ওরা আশ্বস্ত হলো। বিশ্বের এক নম্বর দেশেও যে মেইল মিসিং হয় এর ছোট একটা প্রমাণ।
এদিকে আমরা ইন্সুরেন্স কোম্পানীর কাছে বিল দাবি করলাম। ওরা মাত্র ৩০% ফেরত দিল। ইন্সুরেন্স এর মানে শুভঙ্করের ফাঁকি, এটা আমাদের অনেকেরই ধারণা। তার প্রমাণ পেলাম আমেরিকাতেও। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের ধরণ সব জায়গায় একই রকম। আমেরিকায় ১১ মাসে ছোট করে হলেও আমেরিকার চিকিৎসা সেবার কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন হলো।