তুষারপাত (Snowfall) দেখতে পছন্দ করেন না এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে। এই শীতের প্রথম তুষারপাত অবলোকন করতে না পারায় আমাদের সবারএকটু মন খারাপ ছিল। তুষারপাতের পূর্বাভাস আগে থেকেই আবহাওয়া চ্যানেলগুলো জানিয়ে দেয়। সেই অনুযায়ী এই দূর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির জন্য সকলেই কয়েকদিনের নিত্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে প্রস্তুত থাকে। আবহাওয়া চ্যানেল জানালো ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ থেকে তুষারপাত শুরু হবে। এবার বড় ধরণের তুষারপাত হওয়ার আশংকা করছে। আমরাও সাধ্যমত প্রস্তুতি নিলাম। তবে তুষারপাত আরো দুই-তিন দিন আগে থেকেই শুরু হলো।
তুষারপাত শুরু হলে আকাশটা ধবধবে সাদা হয়ে যায়। এই সাদা অন্যরকম সাদা। আকাশের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে তুষারপাত শুরু হচ্ছে। তুষার বাতাসে উড়ে যায় মনে হয় তুলা উড়ছে। মনোরম সেই দৃশ্য!
সারাদিন তুষারপাত হলো। তাপমাত্রা -১২ ডিগ্রী ফারেনহাইট। তুষারপাতে আস্তে আস্তে চারপাশ সাদা হয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে গাছের মাথা, ঝোপ, রাস্তা সব সাদা হয়ে যাচ্ছে। দেখতে অপূর্ব লাগছে। এটা একটা দূর্যোগ অথচ কত সুন্দর দৃশ্য! জানালার পাশেই ছিলো খাট। সেখানে শুয়ে শুয়ে সারারাত তুষারপাত দেখলাম। আসলে আমার আর ছেলে মেয়েদের জন্য এটাই প্রথম তুষারপাত । আল্লাহর অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে অনেক শোকরিয়া আদায় করেছি।
পরদিনও তুষারপাত হলো। এভাবে টানা ৩ দিন তুষারপাত হলো। আমেরিকার আবহাওয়া চ্যানেল জানালো এবারের তুষারপাত গত ১০০ বছরের রেকর্ড ভংগ করেছে। ৩৯ ইঞ্চি বরফ পড়ল। যা অনেক বিশাল পরিমাণ।
তুষারের মধ্যে হাঁটতে অন্য রকম মজা। তবে বেশিক্ষণ হাঁটা যায় না। বাচ্চারা যতক্ষণ পর্যন্ত তুষারের মধ্যে খেলা যায় ততক্ষণ খেলতো। খুব উপভোগ করেছে। বাসার চারপাশ, বিল্ডিং এর মাঝখানের ফাঁকা জায়গা, পাশের স্টোরের বিশাল মাঠ সবকিছুই বরফে ঢাকা। শুধু মাঝে মাঝে কালো একটা রেখা-রাস্তা এক লেইন দেখা যায়। তুষারপাত আমেরিকার জন্য একটা প্রাকৃতিক দূর্যোগ। কিন্তু তারা ব্যাপারটাকে খুব উপভোগ করে। সবাই বলত আমরা খুব ভাগ্যবান বিশাল তুষারপাত দেখে গেলাম।
এই দূর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য ওদের অনেক ব্যবস্থা, অনেক বাজেট। আমাদের বাসা ছিল মেইন রোড সংলগ্ন। ৩০ মিনিট পর পর তুষার পরিষ্কার করার জন্য বিশেষ গাড়ি স্নোপ্লাউ এসে রাস্তার বরফ পরিষ্কার করে নিয়ে যায়। বিভিন্ন রকমের গাড়ি এই পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত।
টানা ১০ দিন স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সব বন্ধ ছিল। বরফ পরিষ্কার করাটা অনেক কষ্টকর। আমার বাসার সামনে গাড়িগুলো রাস্তায় পার্কিং করা থাকত। ওটাই ওদের পার্কিং। আমরা ভাগ্যবান ছিলাম আমাদের আলাদা গাড়ির পার্কিং ছিলো। বরফে পুরো গাড়ি ঢাকা পড়ে যায়। এই অবস্থায় গাড়ি পরিষ্কার করা খুব কষ্টসাধ্য।
আমাদের বাসার সামনের বাসাগুলোর গাড়ি পার্ক করা থাকত রাস্তায়। ওটাই তাদের পার্কিং এরিয়া। একদিন দেখলাম এক কাপল দুই ঘন্টা ধরে গাড়ির উপরের বরফ কিছুটা পরিষ্কার করে বহু চেষ্টা করলো দরজা খুলতে, কিন্তু পারলো না। অবশেষে বিরক্ত হয়ে গাড়িতে লাত্থি মেরে ঘরে চলে গেল।
বরফ যখন আস্তে আস্তে গলতে শুরু করে তখনকার দৃশ্যটা সম্পূর্ণ বিপরীত। এবার বরফ গলতে প্রায় দেড় মাস লেগেছিল। রাস্তা ঘাট খুব নোংরা হয়ে যায়। তারপর ওদের প্রিয় পেট (পোষা প্রানী) এর টয়লেটগুলো রাস্তায় ভেসে উঠায় হাঁটা খুবই মুশকিল হয়ে যায়।
গাছগুলোর উপর থেকে বরফ সরে যাওয়ার পর কালো ডাল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। গাছের দিকে তাকালে মনে হয় কোন বাচ্চার এলোমেলোভাবে আঁকা গাছের দৃশ্য। বরফ গুলো যখন গাছে ক্রিস্টাল হয়ে থাকে তখন কতই না সুন্দর লাগে। বরফ গলার পর এই গাছগুলোর দিকে তাকালে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো যে এই গাছগুলোতে আবার কখনও পাতা বা ফুল ফুটবে। অথচ ১ মাস পরই কি অপরূপ দৃশ্য। সব গাছে ফুল ফুটে ভরে আছে। প্রতিটা গাছে ফুল অথচ কোন পাতা নেই। ফুল ফোটা শেষ হলে একটু একটু করে পাতা বের হচ্ছে।
আমাদের বাসার মাঝখানে টিউলিপ ফুলের বাগান ছিল। লাল, হলুদ, কমলা টিউলিপ ফুলগুলোর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। আমি ভেবেছিলাম যে পরিমাণ বরফ পড়েছে এগুলোতে এবার আর ফুল ফুটবে না। কয়েকদিনের মধ্যে গাছগুলো পুরো সবুজ। মাত্র ২ মাসের মধ্যে আবারো সবুজ আমেরিকা। আল্লাহ সুবহান আল্লাহ তায়লা সব প্রাকৃতিক পরিবেশে মানিয়ে চলার ক্ষমতা দিয়ে গাছপালা পশুপাখিকে সৃষ্টি করেছেন। এইরকম দূর্যোগের পর আবারও প্রকৃতি তার নিজস্ব রূপে ফিরে আসা এক বিস্ময়কর ব্যাপার।a